ঢাকা রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

পরিবর্তন চাওয়াদের ইচ্ছায় সরকারপ্রধান হয়েছি - মালয়েশিয়ার বারনামাকে মুহাম্মদ ইউনূস

রূপালী বাংলাদেশ
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৫, ১২:২৮ এএম
  • রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার ভূমিকা প্রত্যাশা

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক উদ্যোক্তা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ তার বয়স, আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও জীবন অভিজ্ঞতা তাকে সহজেই শান্ত অবসর বেছে নেওয়ার সুযোগ দিতে পারত। কিন্তু তিনি এখন এমন এক অবস্থানে, যা তার দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্সক্ষার বিষয় নয়, বরং অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

মালয়েশিয়ায় সম্প্রতি এক রাষ্ট্রীয় সফরে দেশটির জাতীয় সংবাদ সংস্থা বারনামাকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব নেওয়া তার জন্য কোনো ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং জনগণের দাবির প্রতিফলন। তিনি বলেন, এটা আমার নয়, এটা সেসব মানুষের চাওয়া, যারা পরিবর্তন চেয়েছিলেন। তারা যেভাবে চলতে চান, আমি শুধু তাদের সেভাবে চলতে সহায়তা করছি।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে ১১ থেকে ১৩ আগস্ট অধ্যাপক ইউনূস দেশটি সফর করেন। তিন দিনের সফরের শেষ দিকে বারনামার প্রধান সম্পাদক আরুল রাজু দুরার রাজ, ইন্টারন্যাশনাল নিউজ সার্ভিসের সম্পাদক ভুন মিয়াও পিং ও বারনামার ইকোনমিক নিউজ সার্ভিসের সহকারী সম্পাদক কিশো কুমারী সুশেদারামের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ক্ষুদ্রঋণ ধারণার পথিকৃৎ হিসেবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী মুহাম্মদ ইউনূস কখনোই রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে নিজেকে কল্পনা করেননি। তার মতে, পরিস্থিতি তাকে খুব কমই বেছে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা নন, বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একজন অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে চান।

অধ্যাপক ইউনূস অকপটে স্বীকার করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন সহজ নয়। তিনি বলেন, এখানে অসুবিধা অনেক। অনেকেই এটাকে ব্যাহত করতে চায়। কেননা, বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত রাজনৈতিক উপাদানগুলো পুরো ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।

তিনি বিশেষভাবে নতুন ভোটারদের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক হলেও প্রকৃত অর্থে নির্বাচনের সুযোগ পাননি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কেউ ১০ বছর ধরে অপেক্ষা করছেন। কেউ ১৫ বছর ধরেও। একবার ভাবুন, আপনার ১৮ বছর বয়স হয়েছে, আপনি ভোট দিতে আগ্রহী। কিন্তু আপনি সেই সুযোগ কখনো পাননি। কারণ, সত্যিকার অর্থে কখনো নির্বাচনই হয়নি। এখন তারা ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার ভোট দিতে পারবেন।

অধ্যাপক ইউনূসের এই বক্তব্যে জাতীয় পরিবর্তনের প্রত্যাশার আলোকরেখা ফুটে ওঠে। দেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরে আসে গত বছরের ৫ আগস্ট। সেদিনের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে। মাত্র তিন দিন পর, ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক উদ্যোক্তা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার ভার দেন।

অধ্যাপক ইউনূসের পেশাজীবন শুরু হয়েছিল আরও কয়েক দশক আগে। ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তখন তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪২টি পরিবারকে মাত্র ২৭ ডলার ঋণ দিয়েছিলেন, যাতে তারা উচ্চ সুদের বোঝা ছাড়াই উৎপাদন ও বিক্রির সুযোগ পায়।

এই ছোট উদ্যোগ থেকেই ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে গবেষণাধর্মী পাইলট প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের সূচনা হয়। ১৯৮৩ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকে রূপ নেয়। উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন।

গ্রামীণ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি ১ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার গ্রহীতাকে মোট ৪০ হাজার ৩৬৮ দশমিক ৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকের সদস্যদের ৯৭ শতাংশই নারীÑ যা নারী ক্ষমতায়নে একটি বিশ্বস্বীকৃত মাইলফলক।

রাজনৈতিক পরিবর্তন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটকেও বাংলাদেশের অন্যতম গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। বারনামাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার প্রভাব, বিশেষ করে আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট) সভাপতির ভূমিকা কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ। তিনি আশা প্রকাশ করেন, মালয়েশিয়া আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং একটি আঞ্চলিক সমাধান বের করতে সহায়তা করবে।

প্রধান উপদেষ্টা সতর্ক করে বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সরকারি বাহিনীর চলমান সংঘর্ষের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তিনি জানান, গত ১৮ মাসে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর সঙ্গে আগে থেকে থাকা প্রায় ১২ লাখ শরণার্থী যোগ হয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

আরেকটি গুরুতর সংকট হলো অর্থায়ন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষণাবেক্ষণের সব ধরনের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। এটি আমাদের জন্য বিশাল এক সংকট।

তিনি জানান, আসন্ন কয়েক মাসে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করা হবে। সেখানে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই সমাধান খোঁজা হবে।

এভাবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মালয়েশিয়া সফর কেবল কূটনৈতিক দিক থেকেই নয়, বাংলাদেশের ভেতরের রাজনৈতিক রূপান্তর ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংকট মোকাবিলার দায়িত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবেও চিহ্নিত হচ্ছে। তিনি যে এখন শুধু একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ নন, বরং গণতন্ত্রের অভিভাবক ও আঞ্চলিক সংকট সমাধানে কণ্ঠস্বরÑ সেটিই নতুন বাস্তবতায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে।