ঢাকা রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

কাজ করে শিক্ষা ক্যাডার স্বামীর প্রতিষ্ঠান, স্ত্রী যার চেয়ারম্যান

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম
  • ই-শিক্ষার চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস, শিক্ষা) মুজাহিদুল ইসলামের স্ত্রী আফিফা
  • প্রায় ৪৮টি সরকারি কলেজে চলে ই-শিক্ষার সফটওয়্যার
  • শুধু মাসিক ফি থেকেই আয় প্রায় ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা
  • সরকারি পদের প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা দেখছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা

দেশের প্রায় ৪৮টি সরকারি কলেজে এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইএমএস) এবং অন্যান্য প্রযুক্তি সেবা দেয় ‘ই-শিক্ষা লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আফিফা ইয়াসমিনের স্বামী ২৪ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ও ঢাকা কলেজের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ এস এম মুজাহিদুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) প্রেষণে নিয়োজিত আছেন। মুজাহিদুল ইসলাম এবং আফিফা ইয়াসমিন দম্পতির ‘ই-শিক্ষা’Ñ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ক্লাউড ভাড়া ও সফটওয়্যার ম্যানেজমেন্ট ফি থেকে মাসে আয় করে প্রায় ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বিষয়টিকে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সরকারি পদের প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা দেখছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, সফটওয়্যার খাতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সদস্য পদই নেই ই-শিক্ষার। 

রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের অন্তত ২৭টি সরকারি কলেজে ইএমএস সফটওয়্যার সেবা দেয় ই-শিক্ষা। তবে ই-শিক্ষার নিজস্ব ওয়েবসাইট বলছে, সরকারি কলেজের সংখ্যা প্রায় ৪৮টি। এসব কলেজের মাঝে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজসহ রাজধানী এবং বিভাগীয় ও জেলা সদরের প্রায় শতভাগ সরকারি কলেজ রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি, ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট বা তথ্য ব্যবস্থাপনা, প্রবেশপত্র ব্যবস্থাপনা, প্রমোশন, আন্তঃবিভাগীয় রদবদল ও পুনঃভর্তি; কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রোফাইল ম্যানেজমেন্ট ও উপস্থিতির তথ্য; কারিকুলাম ও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা; অ্যাকাউন্টস সেবা ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের ফি গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্টদের নোটিশ প্রেরণ, ছুটি ব্যবস্থাপনার মতো সেবা দিয়ে থাকে ই-শিক্ষা। এসব সেবার বিপরীতে সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনা ও ক্লাউড স্পেস ভাড়া বাবদ সরকারি কলেজগুলো থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৩০ হাজার টাকা নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এ হিসাবে ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ই-শিক্ষার মাসিক আয় ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। পাশাপাশি সফটওয়্যার সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিভাইস এবং সংশ্লিষ্টদের এসএমএস পাঠানোর চার্জ আলাদাভাবে বিল করে ই-শিক্ষা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি দরপত্র প্রক্রিয়া এড়াতে এককালীন কোনো চার্জ বা ফি নেয় না ই-শিক্ষা। আর সেবার মাসিক মূল্য রাখা হয় ১ লাখ টাকার নিচে। সূত্র বলছে, মাসিক চার্জ ৩০ হাজার টাকা হলেও অন্যান্য সেবা, বিশেষ করে ডিভাইস ও এসএমএস থেকে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের আয় হয় প্রতিষ্ঠানটির। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক সূত্রের মতে, মাউশির সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভাতিজা অধ্যাপক নেহাল আহমেদের সঙ্গে সখ্যের সুবাদে দেশজুড়ে সরকারি কলেজে নিজের সফটওয়্যার সেবা বিক্রি করেছেন সহকারী অধ্যাপক এ এস এম মুজাহিদুল ইসলাম। একই সঙ্গে সরকারি কলেজগুলোয় কর্মরত তার ব্যাচমেটদের মাধ্যমেও ই-শিক্ষার সফটওয়্যার বসিয়েছেন তিনি। ঢাকা কলেজের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক থাকাকালীন বিভিন্ন সময় পাঠদান ফাঁকি দিয়ে নিজের ব্যবসার পেছনে সময় দিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকা কলেজে দায়িত্ব পালনকালে মুজাহিদুল ইসলামের সরাসরি ছাত্র ছিলেন, এমন একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময়েই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতেন তিনি। 

ই-শিক্ষা লিমিটেডের কোম্পানি নথি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন এক কোটি টাকা। ১০০ টাকা মূল্যের এক লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এর মধ্যে তিন হাজার শেয়ারের মালিক মুজাহিদুল ইসলামের সহধর্মিণী আফিফা ইয়াসমিন। ই-শিক্ষা লিমিটেডের চেয়ারম্যানও তিনি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনৈক শামসুদ্দিন আহমেদ। তিনিও তিন হাজার শেয়ারের মালিক। ই-শিক্ষার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক খাতা-কলমে গোপন রাখতে, প্রতিষ্ঠানটিতে নিজের নামে কোনো শেয়ার রাখেননি মুজাহিদুল ইসলাম।

অন্যদিকে, ই-শিক্ষা সফটওয়্যার সেবা দিলেও, বেসিসে প্রতিষ্ঠানটির কোনো সদস্যপদ নেই। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী, সফটওয়্যার খাতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে আবশ্যিকভাবে বেসিসের সদস্য পদ নিতে হবে। তবে বেসিসের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত সদস্য তালিকায় নেই ই-শিক্ষার নাম। বেসিসের একটি সূত্রও নিশ্চিত করেছেন, ই-শিক্ষার বেসিসে সদস্য পদ নেই। উপরন্তু, দেশের সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় বেসিস সদস্য প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। অথচ বেসিসের সদস্য না হয়েই, প্রায় অর্ধশত সরকারি কলেজে সফটওয়্যার সেবা দিচ্ছে ই-শিক্ষা। বেসিস সদস্যরা বলছেন, ই-শিক্ষার এমন কর্মকা- বেসিস সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈষম্যমূলক। 

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে, বেসিসের সদস্য একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বেসিসের সদস্য পদ পেতে কিছু কমপ্লায়েন্স মানতে হয়। পাশাপাশি প্রথমবার এককালীন ফি এবং প্রতিবছর রিনিউ ফি দিয়ে সদস্য পদ ধরে রাখতে হয়। অর্থাৎ বেসিস সদস্যদের ইন্ডাস্ট্রিতে জবাবদিহিতা আছে, একটা বিনিয়োগ আছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির কোনো জবাবদিহি ও কমিউনিটিতে কোনো বিনিয়োগ নেই। একজন সরকারি কর্মকর্তা এর পেছনে আছেন এবং তিনি তার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিনা টেন্ডারে কাজ করছেন। তাহলে আমাদের তো আর ব্যবসা করার দরকার নাই!’

রাজধানীতে অবস্থিত একটি কলেজের সঙ্গে ই-শিক্ষার চুক্তিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, চুক্তি স্বাক্ষরকালে শাহ মুজাহিদ মুজতবা নামে একজন সাক্ষী উপস্থিত ছিলেন। কলেজ সূত্রে জানা যায়, এ নামে মূলত এ এস এম মুজাহিদুল ইসলামই ই-শিক্ষার পক্ষে স্বাক্ষর করেন। গ্রিন রোডের এ কে কমপ্লেক্সের পঞ্চম তলার একটি অফিস, ই-শিক্ষার ঠিকানা হিসেবে নিবন্ধিত। গত মঙ্গলবার সকাল ১০টায় ওই ঠিকানায় গিয়ে অফিসটি তালাবদ্ধ দেখতে পান প্রতিবেদক। বেলা ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও, অফিস কেউ খোলেনি। অফিসের বাইরের অংশে দরজার পাশের দেয়ালে ই-শিক্ষার একটি ছোট নামফলক রয়েছে। তবে তার পাশেই একজন থেরাপিস্টের চেম্বারেরও নামফলক রয়েছে। ভবনের লিফট অপারেটর এবং ভবনের একাধিক অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ই-শিক্ষা নামক কোনো অফিস এই ভবনে রয়েছে বলে তারা শোনেননি। দিনের অধিকাংশ সময় অফিস কক্ষটি বন্ধ থাকে। ই-শিক্ষাকে সাইনবোর্ড-সদৃশ প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করছেন তারা। 

মুজাহিদুল ইসলাম এবং আফিফা ইয়াসমিন দম্পতির এমন কর্মকা-কে স্বার্থের সংঘাত এবং সরকারি পদের প্রভাব বিস্তার হিসেবে দেখছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘তিনি নিজে যদি শেয়ারের মালিকানায় না-ও থাকেন, তার স্ত্রী এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। আর তিনি সরকারি কর্মকর্তা, এখানে পরিষ্কারভাবে স্বার্থের সংঘাত আছে। অন্যদিকে তিনি অধিদপ্তরে নিযুক্ত আছেন এবং সরকারি কলেজগুলো অধিদপ্তরের অধীন। সে ক্ষেত্রে, তিনি সরকারি পদের প্রভাব খাটিয়েও কাজগুলো পেতে পারেন। এমনটা হলে সরকারি চাকরিবিধিরও লঙ্ঘন হবে। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) অনুসন্ধান করতে পারে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও পৃথক তদন্ত করে বিভাগীয় মামলা দায়ের করতে পারে। যে কলেজগুলো তাদের দেওয়া সফটওয়্যার নিল, তারা কী প্রক্রিয়ায় এবং কেন টেন্ডার ছাড়া সেবা নিল, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। এভাবে টেন্ডার ছাড়া কেউ সফটওয়্যার দিতে পারলে শুধু তার কোম্পানি কেন কাজ পাবে? আরেকটি সফটওয়্যার কোম্পানি কেন পাবে না? এই বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখতে হবে।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আফিফা ইয়াসমিনের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে লাইন কেটে দেন। এরপরেও কয়েক দফা চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তার স্বামী সহকারী অধ্যাপক এ এস এম মুজাহিদুল ইসলামের সঙ্গে মঙ্গলবার বিকেলে যোগাযোগ করা হলে, বিস্তারিত পরে আলাপ করবেন বলে প্রতিবেদককে জানান। তবে সংক্ষিপ্তভাবে তিনি জানান যে, প্রতিষ্ঠানটি তার পারিবারিক। তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে আসার আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটি ছিল। এটা আমার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।’ পরবর্তী সময়ে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি আর যোগাযোগ করেননি।