বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ছাড়া অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করালে শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি থেকে যায়। শিক্ষকসংকটের সমাধান না করে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সংকট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ড. শাহ মো. আমির আলী, পরিচালক জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম)
এক বছর ধরে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএস থেকে ননক্যাডারে ২ হাজার ৪৫০টি পদে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব পাবিলক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) পাঠানো হয়েছে। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সারা দেশের শিক্ষকের মোট চাহিদা পূরণ না হলে এই সংকট কাটবে নাÑ ইউনুছ ফারুকী, বিদ্যালয় শাখার উপপরিচালক, মাউশি
রাজধানীর পুরান ঢাকার টিকাটুলি কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রভাতি ও দিবাথ দুই শাখার (শিফট) ১৫৮২ শিক্ষার্থীর পাঠদান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রধান শিক্ষকসহ মোট পদ রয়েছে ৫০টি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ৩৭ জন শিক্ষক দিয়ে চলছে এমফ স্কুলের শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম। পাশাপাশি স্কুল পরিচালনার জন্য প্রধান শিক্ষকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত হিসেবে চালিয়ে নিচ্ছেন স্কুলের একজন সিনিয়র শিক্ষক। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তিনিও অবসরে যাচ্ছেন। স্কুলে শিক্ষকের সংকট এতটাই প্রকট যে, এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য একাধিক বিষয়েও পাঠদান করছেন।
শুধু তাই নয়, চলতি বছরে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাকনির্বাচনি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য দুটি আলাদা সময়সূচি তৈরি করা হয়েছে, যাতে পরীক্ষা চলাকালীন অন্যান্য শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রমে ব্যাঘাত না ঘটে। প্রাকনির্বাচনি পরীক্ষার সূচি থেকে জানা গেছে, টিকাটুলি কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির মোট ১২টি বিষয়ের মধ্যে ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা সকাল সাড়ে ৮টায় শুরু হয়ে শেষ হবে সাড়ে ১১টায়। বাকি ৬টি পরীক্ষা দুপুর দেড়টায় শুরু হয়ে শেষ হবে সাড়ে ৪টায়।
অর্থাৎ, অনেকটা ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’ পদ্ধতিতে জোড়াতালি দিয়ে চলছে পাঠদান কার্যক্রম। কর্মরত শিক্ষকেরা নিজের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ১৩ জন শিক্ষকের কাজ অতিরিক্ত করতে গিয়ে স্বাভাবিক কারণেই প্রচ- চাপ তৈরি হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে মোট সরকারি স্কুল রয়েছে ৬৯৯টি। এর মধ্যে পুরোনো ৩৩৬টি, নতুন হয়েছে ৩৬৩টি। রাজধানীতে মোট স্কুল রয়েছে ৪৭টি।
এর মধ্যে ৮টিতে স্কুলের সঙ্গে কলেজও সংযুক্ত রয়েছে। এই হিসাবে রাজধানীতে মাধ্যমিক স্তরের মোট স্কুল রয়েছে ৩৯টি। এসব স্কুলে প্রতি শিফটে প্রধান শিক্ষক, সিনিয়র ও সহকারী শিক্ষক পদে অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ২৭। এই হিসাবে দুই শিফটে ৫৪ জন থাকার কথা। কিন্তু টিকাটুলির কামরুন্নেসার মতো রাজধানীর অধিকাংশ স্কুলই চলছে শিক্ষকের সংকট নিয়ে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার স্কুলগুলোয় এই সংকটের মাত্রা ব্যাপক।
সার্ভার জটিলতার কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষকের মোট পদ এবং বর্তমানে কর্মরতদের সংখ্যার বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য দিতে পারেনি মাউশি। তবে মৌখিকভাবে সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজধানীসহ সরকারি স্কুলগুলোয় শিক্ষকের মোট পদ রয়েছে ১৫ হাজারের মতো। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৯ থেকে ১০ হাজার। অর্থাৎ, প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার পদ শূন্য রয়েছে।
সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ৩৯টি স্কুলের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে নিয়মিত প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। বাকি ২৩টি স্কুল চলছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে। স্কুলের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। এতে স্কুল পরিচালনায় দুই ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নিতে পারছেন না। অন্যদিকে নিয়মিত প্রধান শিক্ষক না থাকায় স্কুল পরিচালনার নানা কাজে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
শিক্ষকের চরম সংকট নিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চলছে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে দুই শিফটে ৫০ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন ৩৩ জন। স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১৮টি সেকশনে একজন শিক্ষককে তার বিষয়ের বাইরেও একাধিক ক্লাস নিতে হয়। নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান শাখার কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষক না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। একইভাবে বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই শিফটে ৫৩টি পদের মধ্যে ৩৯জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫৫টি পদের মধ্যে রয়েছেন ৪৭ জন। প্রায় একই অবস্থা আরমানিটোলা, নিউ মডার্ন ও কলেজিয়েট স্কুলে। আবার সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুলে ইংরেজি বিষয়ে আটটি পদ থাকলেও রয়েছেন ৯ জন। মতিঝিল সরকারি বালক বিদ্যালয়েও ইংরেজি বিষয়ের আট পদে দায়িত্ব পালন করছেন ৯ জন শিক্ষক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষকেরা জানালেন, অতিরিক্ত ক্লাস নিতে গিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম হয়ে পড়ছেন তারা। একেকজনকে প্রতিদিন সাত থেকে আটটি ক্লাস নিতে হচ্ছে। এর মধ্যে শিক্ষকদের অসুস্থতা ও নানা কারণে ছুটির বিষয় রয়েছে। তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই অবস্থা। সংকট কবে শেষ হবে বুঝতে পারছেন না। এর মধ্যে অবসরেও চলে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষক। নতুন পদায়ন না দিলে বর্তমানের জোড়াতালির পাঠদানও একসময় ভেঙে পড়তে পারে বলে শঙ্কা করছেন তারা।
সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ বন্ধ থাকা এবং নিয়োগবিধি জটিলতার কারণে মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকের সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করেছে বলে রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সারা দেশে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। পাশাপাশি যেসব শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন, নতুন নিয়োগ না হওয়ায় সেই পদগুলোও দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকছে।’ ২০১৮ সাল থেকে পিএসসির মাধ্যমে নন-ক্যাডারে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়োগ বন্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগবিধিতে সমস্যা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিধিমালা অনুযায়ী সিনিয়র শিক্ষক ৯ম গ্রেড। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী জেলা অফিসারÑ সব পদই নবম গ্রেডের। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী একই গ্রেডের পদে পদোন্নতি হয় না। ফলে সিনিয়র শিক্ষককে পদোন্নতি দিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ নিয়োগের এই পরিস্থিতি সংকটকে জটিল করে তুলেছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, ‘অতি দ্রুত নিয়োগবিধি সংশোধন করে প্রধান শিক্ষক পদে ও শূন্য পদে সহকারী শিক্ষকদের পদায়ন করা প্রয়োজন, না হলে এই সংকটের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে ভেঙে পড়তে পারে মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা।’
সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সমন্বয়ক ও নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘সংকট সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সবই জানেন। স্কুলে শিক্ষক দেওয়ার জন্য আমিও যোগাযোগ করছি। কিন্তু সারা দেশের চিত্র একই রকম। নতুন নিয়োগ না হলে কোত্থেকে দেবে।’
প্রধান শিক্ষক অব্যশই একজন শিক্ষক, কিন্তু সিনিয়র শিক্ষক মাত্রই প্রধান শিক্ষক নন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘একজন সিনিয়র শিক্ষক যখন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকেন, তখন তিনি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে পারেন না।’ স্কুলগুলোয় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে কেন্দ্রীয়ভাবে সারা দেশে বড় ধরনের নিয়োগ প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বিদ্যমান নিয়োগের পরিপত্রে সংশোধনী এনে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।’
শিক্ষকসংকটের সত্যতা স্বীকার করে মাউশির বিদ্যালয় শাখার উপপরিচালক মো. ইউনুছ ফারুকী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রায় এক বছর ধরে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএস থেকে ননক্যাডারে ২ হাজার ৪৫০টি পদে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব পাবিলক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) পাঠানো হয়েছে। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সারা দেশের শিক্ষকের মোট চাহিদা পূরণ না হলে এই সংকট কাটবে না বলে তিনিও মনে করেন। অন্যদিকে বিধি জটিলতার কারণে প্রধান শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি জানান।
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ছাড়া অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করালে শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি থেকে যায় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) পরিচালক প্রফেসর ড. শাহ মো. আমির আলী।
রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, পাঠ্যসূচি, শিক্ষার্থীর ধরন ও মানসিকতা বিবেচনায় নিয়ে একজন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক শিক্ষার্থীকে উৎকৃষ্ট পাঠদান করাতে পারেন। অন্য বিষয়ের শিক্ষকের পক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সম্ভব নয়। শিক্ষকসংকটের সমাধান না করে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, সংকট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন