বাংলাদেশে স্টার্টআপ খাত এক দশকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। এই খাতে উদ্ভাবনী চিন্তা, প্রযুক্তির সংযুক্তি এবং যুব উদ্যোক্তাদের সাহসিকতার কারণে অনেকগুলো উদ্যোগ আজ দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই উদ্যোগগুলো কি সবার আস্থা অর্জন করতে পেরেছে? কিংবা দেশের বাইরে থেকে বিনিয়োগ আসার যে সম্ভাবনা দেখি, তার পথে সবচেয়ে বড় বাধা কী? সম্প্রতি ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ কেলেঙ্কারি যেন এসব প্রশ্নের উত্তর আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছে। সব না হলেও বেশকিছু স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে আস্থায় ভাটা পড়ছে বিনিয়োগকারীদের। ব্যবসায় ঝুঁকি থাকবে তাই কোনো বিনিয়োগকারীর জন্যই মুনাফা নিশ্চিত নয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে স্টার্টআপ ফাউন্ডারদের ব্যক্তিগত সততা ও নীতিনৈতিকতার বিষয়টি।
ফ্লাইট এক্সপার্ট : আস্থার পতনের প্রতীক
কম মূল্যে উড়োজাহাজের টিকিটের প্রলোভন দেখিয়ে অগ্রিম টিকিট বুকিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়ে পালিয়েছে দেশের অন্যতম অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’। প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ, সপরিবারে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। পুলিশ প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করলেও, ভুক্তভোগীদের ক্ষতি পূরণ করা কার্যত অসম্ভব। এই ঘটনা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম নয়, বরং গোটা ইকোসিস্টেমের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর বড়সড় এক আঘাত। ভ্রমণ খাতে এবং বিশেষ করে এয়ার টিকিটিং খাতে এমন প্রতারণার নজির নতুন নয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে গ্রাহকদের কাছে ভুয়া টিকিট বিক্রি করে প্রায় ৫০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছিল ‘টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম’ নামক একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। সমসাময়িক সময়ে ঘটে ই-কমার্স খাতের সর্ববৃহৎ ‘ইভ্যালি’ স্ক্যাম। এ ছাড়াও ২০২৩ সালের অক্টোবরে বিদেশি বিনিয়োগ প্রাপ্ত ই-লজিস্টিক্স প্রতিষ্ঠান ‘পেপার ফ্লাই’ বন্ধ হয়ে যায়।
২০২১ ও ২০২২ সালে পেপার ফ্লাই’তে ২০২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘ইকম’। অথচ বছর ঘুরতেই তহবিল সংকটের কারণ দেখিয়ে বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। বিতর্কিত স্টার্টআপের তালিকায় আরেক বড় নাম ‘নগদ’। মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটিকে মনে করা হতো বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘ইউনিকর্ন’। পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত নয় এমন কোনো স্টার্টআপের বাজারমূল্য বা ভ্যালুয়েশন ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলে, সেটিকে ইউনিকর্ন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় স্টার্টআপ জগতে। সম্প্রতি জানা যায় যে, মূল অর্থের চেয়ে বেশি ভার্চুয়াল অর্থ বা ‘ই-মানি’ তৈরি করে বাজারে ছড়িয়ে রেখেছিল নগদ। এমন বেশকিছু নজিরে প্রশ্ন উঠেছে যে, স্রেফ ব্যবসায়িক কারণেই কি এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে? নাকি ফাউন্ডারদের অসততা বা ভিন্ন উদ্দেশ্যেও এর পেছনে দায়ী? কারণ যাই হোক, এসব ঘটনায় বিপাকে পড়েন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
বিনিয়োগের চিত্র : আশা আছে, সন্দেহও আছে
বাংলাদেশে ২০১০ সালের পর থেকে স্টার্টআপ সংস্কৃতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোতে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে, যার মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে। ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৪৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পায় বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলো। ২০২২ সালে সেটি কমে হয় ১২৫ মিলিয়ন ডলার, যা অব্যাহত থাকে ২০২৩ সালেও। সে বছর ৫০ শতাংশ কমে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭১ মিলিয়ন। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে সেটি আরও ৫০ শতাংশ হ্রাস পায়। সে বছর সর্বাধিক বিনিয়োগ পেয়েছে লজিস্টিকস ও মবিলিটি খাতের স্টার্টআপ।
১৩.৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এসেছে এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এর মধ্যে শুধু ‘পাঠাও’তেই বিনিয়োগ এসেছে ১২ মিলিয়ন ডলার। পরের অবস্থানগুলোতে যথাক্রমে রয়েছে ফিনটেক (৭.৬ মিলিয়ন), জ্বালানি ও জলবায়ু (৩.৩. মিলিয়ন), সফটওয়্যার ও এন্টারপ্রাইজ (৩.৩ মিলিয়ন), ই-কমার্স ও রিটেইল (৩ মিলিয়ন), শিক্ষা বা এডটেক (১.৫ মিলিয়ন), স্বাস্থ্য (১.৩ মিলিয়ন) এবং ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার (১.২ মিলিয়ন)।
খাতভিত্তিক বিনিয়োগ পাওয়া শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে শপ আপ (৬.৫ মিলিয়ন-এডটেক), সোলশেয়ার (১.২ মিলিয়ন-জ্বালানি), মার্কোপোলো ডট এআই (১.৫ মিলিয়ন-সফটওয়্যার), প্রিয়শপ (২.৩ মিলিয়ন-ইকমার্স), টেন মিনিট স্কুল (১ মিলিয়ন-এডটেক), আরোগ্য (১ মিলিয়ন-স্বাস্থ্য) এবং ফসল (১ মিলিয়ন-অ্যাগ্রিকালচার)। বিনিয়োগে এগিয়ে আছে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২৪ সালে বিনিয়োগের ৯৪ শতাংশই এসেছে ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। ২০২৫ সালে প্রথমার্ধে বিজনেস-টু-বিজনেস (বিটুবি) ইকমার্স প্ল্যাটফর্ম ‘শপ আপ’ ছাড়া আর তেমন কেউ বিনিয়োগ আনতে পারেনি। সৌদি আরবভিত্তিক বিটুবি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘স্যারি’ শপ আপে প্রায় ১১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। এটিকে রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োগ বলা হলেও, বাকি খাতগুলোতে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রগতি নেই। প্রি-সিড, সিড এবং সিরিজ এ পর্যায়ে তেমন কোনো বিনিয়োগ হয়নি এখন পর্যন্ত। অর্থাৎ, শুরুতেই নতুন স্টার্টআপগুলো থমকে যাচ্ছে, পুঁজি সংকটে পড়ছে।
স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড, সরকারের উদ্যোগে পরিচালিত ভেঞ্চার ফান্ড, গত বছর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র কয়েক কোটি টাকা বিভিন্ন ছোট প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে টেন মিনিট স্কুল, সেবা এক্স ওয়াই জেড, শেয়ারট্রিপ, এয়ারিয়া৭১ প্রভৃতি। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগের গতি অনেক ধীর, এবং প্রক্রিয়াও জটিল।
পথ কী?
আস্থা ফিরে পেতে হলে আমাদের স্টার্টআপদের অবশ্যই কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন-
নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি স্টার্টআপকে নির্ধারিত ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ মানতে বাধ্য করতে হবে। উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক আচরণ প্রমাণিত হলে দ্রুত বিচার ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ‘রেটিং সিস্টেম’ চালু করতে হবে, যাতে তারা স্টার্টআপের ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে পারেন। তা ছাড়া, স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের মতো সরকারি ফান্ডগুলোকে আরও গতিশীল ও প্রযুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করতে হবে। প্রয়োজনে এই ফান্ডগুলোকে আংশিক বেসরকারি পরিচালনার অধীনে আনতে হবে।
শেষ কথা
উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা মানেই ভবিষ্যৎ, কিন্তু সেটা হতে হবে স্বচ্ছ এবং নৈতিক ভিত্তিতে দাঁড়ানো। বাংলাদেশের স্টার্টআপরা যদি চায় যে, বিশ্বের বড় বিনিয়োগ তাদের দিকে তাকাবে, তাহলে প্রথমে তাদের নিজের ঘর পরিষ্কার করতে হবে। ফ্লাইট এক্সপার্ট কেলেঙ্কারির মতো উদাহরণগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্বাস হারালে সব হারাতে হয়। আমরা চাই, এই ঘটনার মাধ্যমে উদ্যোক্তারা শিখুক, কেবল প্রযুক্তি আর ‘পিচ ডেক’ দিয়ে নয়, সত্যিকারের মূল্যবোধ দিয়েই তৈরি হয় একটি টেকসই প্রতিষ্ঠান।
শাওন সোলায়মান
প্রযুক্তি বিটের সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন