ঢাকা রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৫

অপপ্রচার ঠেকাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি  

রুবেল রহমান
প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০২৫, ০৫:৪৭ এএম
বিএনপির লোগো। ছবি- সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ বিদায় নিলেও প্রতিপক্ষের অপপ্রচারে নাস্তানাবুদ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। দেশে যা কিছু ঘটে, যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিএনপির ওপর দায় চাপানো হচ্ছে বলেও মনে করেন দলটির নেতারা। এ নিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’। দলের পক্ষ থেকে এসব অপপ্রচার ঠেকাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এ জন্য দলের পক্ষ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাইবার সেলে দক্ষ জনবল নিয়োগেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ যেভাবে বিএনপির ওপর দোষ চাপিয়ে ১৬ বছর পার করেছে, তেমনি এখনো একটি মহল বিএনপির ওপর দোষ চাপাতে চাইছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন প্রচারণা চলছে নিয়মিত।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, শুধু তারেক রহমানই নন, দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরাও অনলাইনে মিথ্যা প্রচারণার শিকার হচ্ছেন। তাদের দাবি, অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রচারণা সাজানো। তার মধ্যে মিটফোর্ডে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যা ও গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যা উল্লেখযোগ্য। বিএনপির ওপর দোষ চাপাতে গিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়ে প্রকৃত ঘটনা হালকা হয়ে যায়, আসামিরা পার পেয়ে যায়।

গত ১৩ আগস্ট চট্টগ্রামে ভাইরাল হওয়া এক চিকিৎসকের ভিডিও নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, ‘ভিডিওটি দেখে আমি এবং সংশ্লিষ্টরা তাৎক্ষণিক খোঁজখবর নিয়েছি, এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করা হয়নি। নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণ করায় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে। তার ওপর কেউ হামলা করেনি, তিনি নাকে রং লাগিয়ে লাইভে এসে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছেন। সামনে নির্বাচন, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসব করা হচ্ছে।’

অন্যদিকে সম্প্রতি ‘যশোরে ব্যবসায়ীকে বালুতে পুঁতে চাঁদা আদায়’ বা ‘মহাখালীতে যুবদল নেতার নেতৃত্বে হোটেলে ঢুকে নারীদের ওপর হামলা’ ইত্যাদি ঘটনার কারণেও বিরোধীরা বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সুযোগ পাচ্ছে। এতে নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম বলেন, ‘বর্তমানে বিএনপি ও ছাত্রদল অতিমাত্রায় অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে। এর একটি কারণ রাজনীতির অসহিষ্ণুতা। বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কর্মীরা প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে মিডিয়ায় অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমরা মিডিয়ায় শক্তভাবে এর প্রতিবাদ করতে পারছি না। যদিও আমরা মিডিয়া অপপ্রচার ও গুজবে বিশ্বাসী নই, আমরা যতটা সম্ভব বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আশা করি ভবিষ্যতে শক্তিশালী গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি সেল করে আরও শক্ত প্রতিবাদ করব।’

ভোলা-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা একটু এবসেন্ট, উদাসীন ছিলাম। এরই মধ্যে নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। অপপ্রচারের বিপরীতে সঠিক বিষয়টা জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক থাকার কারণে জনগণও জানে যে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে।’

সিরাজগঞ্জ-২ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নাজমুল হাসান বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা প্রযুক্তিসচেতন। রাজপথের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ভূমিকা রাখছে। এআই প্রযুক্তির সঙ্গেও পরিচিত হচ্ছে।’

এদিকে ঢাকা-১৮ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুর্বলরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চালায়। কিন্তু এটা শেষ পর্যন্ত টেকে না। আমরা মানুষের জন্য কাজ করছি। দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে শেখ হাসিনা। আমরা সেটি ঠিক করার জন্য কাজ করছি আর একটি মহল সমানে অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে। তারা জানে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তাই অপপ্রচারে লিপ্ত।’

ঢাকা-১৬ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘মিথ্যাচার তো মিথ্যাচার। আমাদের দলের মধ্যে যদি কোনো নেতাকর্মী অনৈতিক আশ্রয় নেয়, আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না। কিছু মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে। এসবের বিরুদ্ধে আমরা সজাগ আছি। মানুষ বোঝে কারা এসব করে। তাদের একটি উদ্দেশ্য আছে। দিন শেষে সব প্রকাশ হয়ে যায়।’

গোপালগঞ্জ-১ আসনের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারণা প্রবল হয়। যেমন চকবাজারে সোহাগ হত্যার ঘটনায় অপপ্রচার হয়েছিল, বিএনপি কয়েকজন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছিল। পরে দেখা যায় তারা জড়িত নয়। যাচাই-বাছাই করে এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। নির্বাচন সামনে রেখে পতিত স্বৈরাচার ও স্বাধীনতাবিরোধী দুই পক্ষ সক্রিয় হয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। নেতাকর্মীদেরও সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার হওয়া দরকার।’

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অপপ্রচারের পাল্টা অপপ্রচারের নীতি বিএনপির নেই। অপপ্রচারের জবাবে দলীয় বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলন, মিডিয়া সেল ও অফিসিয়াল পেজের মাধ্যমে সঠিকটা তুলে ধরা হয়।’

নাটোর-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘গত ১৭ বছর বিএনপির নেতাকর্মীরা নানা ধরনের অপপ্রচারের শিকার হয়েছে। জনগণের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক নেই, তারাই এসব করে। বিএনপির সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক রয়েছে। দিন শেষে জনগণ বোঝে এগুলো অপপ্রচার।’ টাঙ্গাইল-৫ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ‘অপপ্রচারের জবাব বিএনপির নেতাকর্মীরা ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে দেবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতাকর্মীরা আগের চেয়ে বেশি সোচ্চার। অপপ্রচারের ফলে সাময়িক ক্ষতি হয়, তবে দল তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়।’

ঢাকা-৮ অথবা ৯ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ও যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল  রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমরা একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছি। অনুরোধ করেছি কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধের জন্য। এতে পতিত স্বৈরাচারের সুযোগ হবে। নেতাকর্মীদের বলেছি, অপপ্রচার হলে তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে জবাব দিতে।’ ঢাকা-১৩ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিএনপির মিডিয়া সেল ও বিএনআরসি (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ সেন্টার) রয়েছে, সেখানে আরও দক্ষ ও অভিজ্ঞদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেলা পর্যায়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগও টার্গেট করত বিএনপিকে। এখন যারা নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে পারবে না, সেটি নিশ্চিত হয়েই বিএনপির বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।’

চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মী বিএনপিকে ভালো চেনে। কোনটা অপপ্রচার, কোনটা সম্প্রচার, কোনটা গ্রহণীয়- এটা তারা জানে। অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে যদি বিএনপিকে ধ্বংস করা সম্ভব হতো, শেখ হাসিনা সেটা করতে পারতেন। প্রচার ও অপপ্রচার দুটোকে সামনে রেখে বিএনপি এগোচ্ছে’।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান রূপালী বাংলাদেশকে  বলেন, ‘অপপ্রচার হলো যা সত্য নয়। সত্যতা থাকলে তা এমনি প্রকাশ পায়। আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে, নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা সাংগঠনিকভাবে চেষ্টা করছি। সমাজে অস্থিরতা বেড়েছে, কেউ কারও কথা শুনছে না। এই পরিস্থিতিতে আমরা সত্য ও সঠিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিনকে কী কারণে হত্যা করা হলো সবাই জানতে পেরেছে, কিন্তু তাকে হত্যার পর সবার আগে জানতে পারল এনসিপি নেতারা। তারা পোস্ট দিল- বিএনপি নেতার চাঁদাবাজির লাইভ করায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। এমন একটা মিথ্যা প্রচারণার পর যখন আসল ঘটনা প্রকাশ পেল, তখন কি তারা তাদের সেই বক্তব্য প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করেছে? করেনি, আমরা সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, দিন শেষে সত্যের জয় হয়, মিথ্যাবাদীদের মুখোশ দেশের জনগণ উন্মোচন করে দেয়।’