- ভূমিকম্পে আহত অন্তত ২৮০০। বাড়তে পারে আহত ও নিহতের সংখ্যা
- রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬
- আফগানিস্তানে ১০ বছরে ৭ ভূমিকম্পে নিহত কয়েক হাজার
- দুর্গম অঞ্চল ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত
- ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন বহু মানুষ
- নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ
- ১২ হাজার মানুষ ভূমিকম্পে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেনÑ জাতিসংঘ
- অন্তত নয়টি আফটার শক অনুভূত। পরবর্তী দুই দিনে আরও ভূকম্পনের আশঙ্কা
আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন প্রদেশ কুনার ও নানগারহারে ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন আট শতাধিক। আহত হয়েছেন অন্তত আড়াই হাজার। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ ঘটনায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে উপদ্রুত অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
গত রোববার রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে পাকিস্তান সীমান্তের কাছে জালালাবাদ শহর থেকে ১৭ মাইল দূরে স্থানীয় সময় ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পের পর অন্তত তিনটি পরাঘাত অনুভূত হয়েছে, যার মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫ থেকে ৫ দশমিক ২ এর মধ্যে।
আফগান সরকারের মুখপাত্র মৌলভি জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভূমিকম্পে নিহত হয়েছে আট শতাধিক। আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজারে। শুধু কুনার প্রদেশেই নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৮০০ ও আহতের সংখ্যা আড়াই হাজার হয়েছে। নানগারহার প্রদেশে আরও ১২ জন নিহত ও ২৫৫ জন আহত হয়েছেন। উদ্ধারকাজ চলছে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, কমপক্ষে ১২ হাজার মানুষ ভূমিকম্পে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আফগান জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শরাফত জামান জানান, ভূমিকম্পটি দুর্গম পার্বত্য এলাকায় হওয়ায় প্রাণহানি ও অবকাঠামোগত ক্ষতির সঠিক তথ্য পেতে সময় লাগবে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার অভিযান চলছে। শত শত মানুষকে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। এ মুহূর্তে আমাদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
রাজধানী কাবুলে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উদ্ধারকারীরা পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন নানগারহার ও কুনারের প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের ছোট ছোট গ্রামগুলোতে পৌঁছানোর জন্য সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন। ভূমিকম্পে ওই অঞ্চলের পর্বতের ঢালগুলোতে মাটি ও পাথর দিয়ে তৈরি ঘরগুলো ধসে পড়েছে।
যদিও দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল এবং ভূমিকম্পে রাস্তার ক্ষতি হওয়ায় উপদ্রত অঞ্চলে উদ্ধারকর্মীদের পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে। এদিকে রোববার রাতের ভূমিকম্পের পরে এ অঞ্চলজুড়ে অন্তত ৯টি আফটার শকের কথা জানিয়েছে পাকিস্তান। দেশটির সিসমোলজি সেন্টারের পরিচালক নাজিব আহমেদ আমির আলজাজিরাকে জানান, আগামী দুই দিন এমন আফটার শক অনুভূত হতে পারে। এ পর্যন্ত আমরা ৯টি কম্পন রেকর্ড করেছি।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এ ভূমিকম্পটি মাত্র পাঁচ মাইল বা আট কিলোমিটার গভীরতায় আঘাত হানায় এর ক্ষয়ক্ষতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। কারণ, অগভীর ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে থাকে।
আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। দেশটি ভারত ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। এর পাশাপাশি পূর্ব আফগানিস্তানের দুর্গম পার্বত্য এলাকায় ভূমিধসের ঝুঁকি থাকায় উদ্ধারকাজ আরও জটিল হয়ে ওঠে। পূর্ব আফগানিস্তানের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো পাহাড়ি এলাকা এবং তুলনামূলকভাবে জনসংখ্যার ঘনত্বের উচ্চহারের কারণে এখানকার মানুষের প্রাণহানির ঝুঁকি বেশি থাকে বলে আলজাজিরাকে জানিয়েছেন কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ভূতত্ত্বের অধ্যাপক ক্রিস এল্ডার্স।
সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার তথ্যমতে, গত এক দশকে ২০১৫ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অন্তত সাতটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে। এসব ভূমিকম্পে নিহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ অঞ্চলের কাছে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি) অনুসারে, এ ঘটনায় নিহত হন ১১৭ জন।
পরবর্তীতে ২০২২ সালেই আঘাত হানে তিনটি ভূমিকম্প। ১৭ জানুয়ারি, পশ্চিম আফগানিস্তানের বাদগিস প্রদেশের কাদিস জেলায় ৫ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয় অন্তত ২৬ জন। একই বছরের ২২ জুন পূর্ব আফগানিস্তানের পাক্তিকা, পাকতিয়া, খোস্ত এবং নাঙ্গারহার প্রদেশে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ছিল সহ¯্রাধিক। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী প্রদেশ কুনার এবং নাঙ্গারহারে ৫ দশমিক ১ এবং ৪ দশমিক ৬ মাত্রার দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এ ঘটনায় কমপক্ষে আটজন নিহত হয়। ২০২৩ সালের ২১ মার্চ আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাদাখশান প্রদেশে ৬ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হন অন্তত ১৩ জন।
তবে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতি ও ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে। এই মাসে হেরাত প্রদেশে তিনটি ভূমিকম্প হয়। প্রথমটি ৭ অক্টোবর, পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর তিন দিন পরে, একই প্রদেশে ১১ অক্টোবর, ৬ দশমিক ৩ এবং ১৫ অক্টোবর ৬ দশমিক ৪ মাত্রার আরও দুটি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়। ব্রিটিশ রেড ক্রস সোসাইটির মতে, কয়েক দিনের ব্যবধানে তিনটি ভূমিকম্পে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৪৪৫ জন। সর্বশেষ ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে রোববার রাতে।
এদিকে, রোববার আফগানিস্তানের যে অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছে, যেখানে শত শত বাড়িঘর ধসে গিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছে তালেবান সরকারের একটি সূত্র। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভূমিকম্পে পাশাপাশি কয়েকটি গ্রাম ধসে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভূমিধ্বসের কারণে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাট ভেঙে বহু এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের ফলে জরুরি চিকিৎসা সহায়তা দিতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে স্থানীয় চিকিৎসকদের।
আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশের রাজধানীর প্রধান হাসপাতালের চিকিৎসক মুলাদাদ বিবিসিকে জানান, ভূমিকম্পের পর তিনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি। হাসপাতালটিতে আহতদের চিকিৎসায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, পুরো হাসপাতাল আহতদের দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেছে। প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন করে আহত হাসপাতালে আসছে চিকিৎসার জন্য।
এদিকে ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে আহত ও নিহতের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু ও বয়স্করা রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। এখনো বহু নারী ও শিশু বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছে। কুনার প্রদেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি নুরগাল জেলা। এ জেলার এক বাসিন্দা আলজাজিরাকে বলেন, আমাদের পুরো গ্রাম ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। এখানে প্রতিটি বাড়িতে শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন। এ মুহূর্তে আমাদের জরুরি উদ্ধার সহায়তা প্রয়োজন।
এদিকে আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনায় শোক জানিয়েছে ভারত, চীন, তুরস্ক, আজারবাইজান, ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ এক শোক বার্তায় বলেন, আমরা আফগানিস্তানের মানুষের পাশে আছি। আমাদের উদ্ধারকারী দল ইতোমধ্যে সেখানে পৌঁছে সাহায্য কাজ শুরু করেছে। সব ধরনের সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত।