ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের জয়জয়কার। ভিপি (সহ-সভাপতি), জিএস (সাধারণ সম্পাদক) ও এজিএস (সহ-সাধারণ সম্পাদক) এবং ১২টি সম্পাদক পদের মধ্যে ৯টিতেই জয় পেয়েছে তারা। বাকি তিন পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার ভোটগ্রহণের পর সারারাত পেরিয়ে গতকাল বুধবার সকালে বিশ^বিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ফল ঘোষণা করেন ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন। ফল ঘোষণার পর দুদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্রশিবির।
ভিপি পদে শিবিরের নেতা আবু সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। এছাড়াও স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের উমামা ফাতেমা পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৮৯ ভোট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের আবদুল কাদের ১ হাজার ১০৩ এবং প্রতিরোধ পর্ষদের তাসনিম আফরোজ ইমি পেয়েছেন ৬৮ ভোট। একই সঙ্গে ভিপি ৪৫ প্রার্থীর মধ্যে তিনজন একটি করে ভোট পেয়েছেন। তারা হলেন- সুজন হোসেন, রাকিবুল হাসান ও রাসেল হক। তিন প্রার্থী নাছিম উদ্দীন, সোহানুর রহমান ও মো. হাবিবুল্লাহ পেয়েছেন দুটি করে ভোট। তিনটি করে ভোট পেয়েছেন আরও তিন প্রার্থী; তারা হলেন মুদাব্বীর রহমান, হেলালুর রহমান ও শাহ জামাল সায়েম।
জিএস পদে বিজয়ী ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারি হামিম পান ৫ হাজার ২৮৩ ভোট। এছাড়াও প্রতিরোধ পর্ষদের প্রার্থী ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের নেতা মেঘমল্লার বসু ৪ হাজার ৯৪৯, স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরী ৪ হাজার ৪৪ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের আবু বাকের মজুমদার পেয়েছেন ২ হাজার ১৩১ ভোট।
অপরদিকে এজিএস পদে শিবিরের মহিউদ্দীন খান ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। এছাড়াও ছাত্রদলের তানভীর আল হাদী মায়েদ পান ৫ হাজার ৬৪ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমীদ আল মুদাসসীর পেয়েছেন ৩ হাজার ৮ ভোট, প্রতিরোধ পর্ষদের জাবির আহমেদ জুবেল পেয়েছেন ১ হাজার ৫১১ ভোট, এ ছাড়া মহিউদ্দিন রনি ১ হাজার ১৩৭, আশরেফা খাতুন ৯০০, আশিকুর রহমাস জিম ৭৯৬ ও হাসিব আল ইসলাম ৫২০ ভোট পেয়েছেন।
একইসঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ফাতেমা তাসনিম জুমা ১০ হাজার ৬৩১ ভোট, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ইকবাল হায়দার ৭ হাজার ৮৩৩ ভোট, আন্তর্জাতিক সম্পাদক খান জসিম ৯ হাজার ৭০৬ ভোট , ছাত্র পরিবহন সম্পাদক আসিফ আবদুল্লাহ ৯ হাজার ৬১ ভোট, ক্রীড়া সম্পাদক আরমান হোসাইন ৭ হাজার ২৫৫ ভোট, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে উম্মে ছালমা ৯ হাজার ৯২০ ভোট, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক সাখাওয়াত জাকারিয়া ১১ হাজার ৭৪৭, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে এম এম আল মিনহাজ ৭ হাজার ৩৮ ভোট এবং ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম ৯ হাজার ৩৪৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। শিবির প্যানেলের বাইরে সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবাইর বিন নেছারী ৭ হাজার ৬০৮ ভোট, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ ৭ হাজার ৭৮২ ভোট এবং গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বি ১১ হাজার ৭০৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।
দুই দিনের কর্মসূচি ছাত্রশিবিরের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে বিজয় উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের বিজয়ের মাধ্যমে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন। এ নির্বাচনে যারা বিভিন্ন প্যানেল থেকে ও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
ছাত্রশিবিরের দুই দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ শুকরিয়া আদায় করে দোয়া মাহফিল ও শব্বেদারি (নৈশ ইবাদত) বাস্তবায়ন; শহীদদের কবর জিয়ারত এবং শহীদ পরিবার ও আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে ছাত্রশিবিরের সব মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয়, শহর ও জেলা শাখাকে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি কোনো ধরনের আনন্দ মিছিল, শোভাযাত্রা বা র্যালি আয়োজন না করার জন্যও অনুরোধ জানানো হয়।
নির্বাচন প্রত্যাখ্যান: ডাকসুর ভোটগ্রহণ এবং ভোটগণনার প্রক্রিয়ার পর কেন্দ্রভিত্তিক ফল ঘোষণা শুরু হয় গত মঙ্গলবার রাত দেড়টায়। সিনেট ভবনে ডাকসুর পূর্ণাঙ্গ ফল ঘোষণা করা হয় গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায়। তবে ডাকসু নির্বাচনের এই ফল প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা। ভোট গণনা চলার মধ্যে গত মঙ্গলবার রাত সোয়া ২টার পর এক ফেসবুক পোস্টে আবিদ লেখেন, ‘পরিকল্পিত কারচুপির এই ফল দুপুরের পরপরই অনুমান করেছি। নিজেদের মতো করে সংখ্যা বসিয়ে নিন। এই পরিকল্পিত প্রহসন প্রত্যাখ্যান করলাম।’ এর ঘণ্টাখানেক পর এক ফেসবুক পোস্টে ডাকসু বর্জনের ঘোষণা দেন উমামা ফাতেমা। তিনি লেখেন, ‘বয়কট! বয়কট! ডাকসু বর্জন করলাম।’ ডাকসু নির্বাচনকে ‘সম্পূর্ণ নির্লজ্জ কারচুপির নির্বাচন’ আখ্যায়িত করে উমামা ফাতেমা লেখেন, ‘৫ আগস্টের পরে জাতিকে লজ্জা উপহার দিল ঢাবি প্রশাসন। শিবির পালিত প্রশাসন।’
এদিকে দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাবি ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ ছিল না। আবাসিক হলে থেকে ক্যাম্পাসে শিবির সন্দেহে মারধরের ঘটনাও দেখা যায়। তবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালু করে ছাত্রশিবির। এক বছরের মাথায় ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের বিশাল জয় শক্ত অবস্থানকে নির্দেশ করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জয়ের নেপথ্যে শিবিরের জুলাই অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণ, পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন