দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম গণ বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে স্থায়ী অধ্যাপক আছেন মাত্র ১২ জন। স্থায়ী ১৭৮ শিক্ষকের মধ্যে ৯৯ জনই প্রভাষক। এর বাইরে আরও ১২ জন শিক্ষক আছেন যারা খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করেন। একই অবস্থা ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ৩২৫ জন পূর্ণকালীন আর ১৯২ জন খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে। শিক্ষকদের মধ্যে অধিকাংশই প্রভাষক। এর মধ্যে ১৯৮ জন স্থায়ী এবং ২৭ জন খণ্ডকালীন প্রভাষক। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ইস্ট ওয়েস্টেও স্থায়ী অধ্যাপক মাত্র ২৯ জন এবং খণ্ডকালীন হিসেবে কর্মরত আছেন ৮৭ জন। একই অবস্থা দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও।
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২ জন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র একজন করে অধ্যাপক কর্মরত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধিকাংশই প্রভাষক। প্রভাষক আর খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই পিএইচডিধারী শিক্ষকও। শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকও নেই অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে প্রতি বছরই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না শিক্ষার মান। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চ শিক্ষার আশায় শিক্ষার্থীরাও এখন আর আসছে না বাংলাদেশে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৫০তম বার্ষিক প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে এসব তথ্য। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো ২০২৩ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ইউজিসি।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ হাজার ৪২ জন শিক্ষক কর্মরত। এর মধ্যে ৫ হাজার ২৭৬ জন ছুটিতে রয়েছেন। যাদের মধ্যে অধ্যাপক ৫ হাজার ২৫৭ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৩ হাজার ৮৫ জন, সহকারী অধ্যাপক ৫ হাজার ১৯৮ জন, প্রভাষক ২ হাজার ৩৪১ জন এবং অন্যান্য পদে ১ হাজার ৩১ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও অধিকাংশ শিক্ষকের নেই পিএইচডি বা উচ্চতর ডিগ্রি। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র ৬ হাজার ৪০৭ জনের পিএইডি আর ১ হাজার ৩২ জনের এমফিল ডিগ্রি আছে।
বেহাল অবস্থা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর
ইউজিসির তথ্য মতে, পাঠদান চালু থাকা ১০৩টি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৭৯। যাদের মধ্যে পূর্ণকালীন শিক্ষক ১৩ হাজার ১৬৯ জন এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন ৪ হাজার ৩১০ জন। এ ছাড়াও পূর্ণকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ৯৫২ জন, সহযোগী অধ্যাপক ১ হাজার ১১৯ জন, সহকারী অধ্যাপক ৩ হাজার ৪১০ জন, প্রভাষক ৭ হাজার ৪৭৮ ও অন্যান্য ২১০ জন শিক্ষক।
খণ্ডকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ১ হাজার ৭ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৫ হাজার ৯৯ জন, সহকারী অধ্যাপক ৬৯৮ জন, প্রভাষক ১ হাজার ৬৫০ জন ও অন্যান্য পদে ৩৫৬ জন রয়েছেন।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিধারী শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ৬০৩। যাদের মধ্যে পূর্ণকালীন ২ হাজার ৭২ এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক ১ হাজার ৫৩১ জন।
ইউজিসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ বা প্রোগ্রামের খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা পূর্ণকালীন শিক্ষক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে না।’ এই নীতি অনুযায়ী ২০২৩ সালের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন শিক্ষকের তুলনায় খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা বেশি যা, আইন অনুযায়ী সন্তোষজনক নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগের দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তাদের মনোযোগ তেমন নেই। উপযুক্ত ও মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের জন্য যে আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন তা তারা করতে চান না। ফলে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। রাজধানীর বাইরে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাও বেশ নাজুক। সেগুলোয় চাহিদামতো খণ্ডকালীন শিক্ষকও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শিক্ষক সংকট থাকছে।
শিক্ষার্থী অনুপাতে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক
বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের নূন্যতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। কিন্তু দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অনুপাতের সংখ্যায় চোখ কপালে তুলবে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৪১, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১:৪২ এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১:৩৯। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাও একই।
দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টি বিশ্ববিদ্যালয় এই শর্ত পূরণ করতে পেরেছে। তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বিইউপি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় এই শর্ত পূরণ করতে পেরেছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোরও একই অবস্থা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৩৬, ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সে ১:৩৫, এনপিআই ইউনিভার্সিতে ১:৩৭। এ ছাড়া বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গড়ে শিক্ষক অনুপাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১:২১।
কমেছে বিদেশি শিক্ষার্থীও
শিক্ষক সংকটসহ নানা সংকটের কারণে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০১৪ সালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিলেন ১ হাজার ৬৪৩ জন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৮২৬ জনে। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৮৭ জন।
তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতেগোনা কিছুটা বেড়েছে। ২০১৪ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৩২। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩৩ জনে। তবে ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬৭০।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ বলেন, আওয়ামী আমলে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এগুলোর অনেকটিতে পাঠদানও শুরু হয়েছে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দসহ নানা সংকটে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ বা অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে গুণগত পাঠদানের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। গবেষণাতেও পিছিয়ে পড়ছি আমরা। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জনবল নিয়োগের বিষয়ে ইতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করছি। প্রাইভেটেও অভিজ্ঞ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।