এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে যেমন নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচিত হবে, তেমনি চলমান স্বল্পোন্নত দেশের অনেক সুযোগ-সুবিধা কমে আসবে বাংলাদেশের। এই পরিস্থিতিতে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নীতি-সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বাজেট সহায়তা হিসেবে এই অর্থের পরিমাণ হতে পারে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। এই বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে প্রাথমিক সভা করেছে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে একটি মিশন পাঠাবে তারা।
এই বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের একটি টিম এসে আমাদের সাথে সভা করে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের সব প্রস্তাব আমলে নিইনি। শুধু এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বিষয়ে রপ্তানিনীতি সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবে আমরা আগ্রহ দেখিয়েছি। এই বিষয়ে আরও আলোচনার পর বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে।
সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংক চাইছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের রপ্তানিতে যে সমস্যা তৈরি হবে, তা উত্তরণে নীতিগত সহায়তা দিতে। যাতে সরকারি-বেসরকারি খাত সেসব বাধা দূর করে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি উন্নত করতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকেও (বিটিটিসি) নীতি-সহায়তা দিতে চায় বিশ্বব্যাংক।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের সাথে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের সভায় একাধিক প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। আর বিটিটিসির বিষয়ে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তার পর বলা হয়, আগে রপ্তানিনীতি বিষয়ে যে প্রস্তাব এসেছে, তা নিয়ে কাজ শেষ হলে পরে এই নিয়ে আলোচনা করা যাবে। ফলে এই বিষয়ে আলোচনা আর এগিয়ে নেওয়া হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বিষয়ে রপ্তানিনীতি সহায়তার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর পর এই বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। এখন সংস্থাটির একটি মিশন এসে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক রপ্তানিনীতি সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিধায় তারা সংস্থাটিকে আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করার জন্য বলেছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। এ বিষয়ে তাদের একটি সভাও হয়েছে। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে একমত হলে অর্থ বিভাগ পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে যেমন নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচিত হবে, তেমনি চলমান স্বল্পোন্নত দেশের অনেক সুযোগ-সুবিধা কমে আসবে বাংলাদেশের। এ পরিস্থিতিতে প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক ও অন্যান্য শিল্পপণ্যের বাজার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি স্থানীয় শিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
সরকার বলছে, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে, যা বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক সুবিধাসহ বেশ কিছু সুযোগের দ্বার উন্মোচন করবে। এতে দেশের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে। তবে এলডিসি উত্তরণের মূল চ্যালেঞ্জ বেসরকারি খাতের। সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ রপ্তানি খাতে। দেশীয় শিল্প তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতও এ চ্যালেঞ্জের বাইরে থাকবে না। স্বল্পোন্নত দেশের সব সুযোগ-সুবিধা কমে আসবে। বিশেষ করে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা ও রপ্তানি প্রণোদনা, শুল্ক কাঠামো কমিয়ে আনতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ও অন্যান্য শিল্পপণ্যের বাজার সমুন্নত রাখতে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় শিল্পগুলোকেও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশ্বব্যাংক বাজেট সহায়তার নামে সেই সক্ষমতা বাড়ানোর জন্যই নীতি সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারকে ব্যাবসায়িক খরচ কমিয়ে আনতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ স্থাপনে বিশেষ প্রণোদনা ও উৎসাহ প্রদান, প্রযুক্তি হস্তান্তরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বহুমুখী পণ্য উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প স্থাপনে ভূমি, ইউটিলিটি-সুবিধাসহ অন্যান্য নীতিগত সুবিধা সহজলভ্য করা, শিল্পভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি তৈরি, লজিস্টিক সহায়তা, বন্দর ব্যবস্থাপনার উন্নতকরণ, আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।