ঢাকা শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫

ঐকমত্য কমিশন আলোচনা শেষ

বিভাজন কাটেনি, সনদ স্বাক্ষর ১৫ অক্টোবর

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৫, ১১:২৩ পিএম

গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে বিভাজন থাকলেও আগামী ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষরিত হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কার্যালয়ের সভাকক্ষে কমিশনের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। ঐতিহাসিক এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন।

সভায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের ৫টি বৈঠকে প্রাপ্ত মতামত বিশ্লেষণ করা হয়। বৈঠকে আশা প্রকাশ করা হয়, বিশেষজ্ঞদের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া অভিমতগুলো বিশ্লেষণ করে খুব শিগগিরই বাস্তবায়নের উপায় সংক্রান্ত সুপারিশ এবং চূড়ান্তকৃত জুলাই সনদ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে। বৈঠকে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া উপস্থিত ছিলেন।  

এর আগে গত বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পঞ্চম ও শেষ দিনের মতো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্যের মধ্যেই আলোচনা শেষ হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের সমন্বয়ে দুই-এক দিনের মধ্যে সরকারকে চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করা হবে। এদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত দীর্ঘ এ আলোচনায় অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আলোচনা বিটিভি নিউজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে বিভাজন :

দলগুলোর অবস্থান বুধবারের আলোচনায় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিএনপি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ ও সমমনা জোট জাতীয় নির্বাচনের দিন একযোগে গণভোট আয়োজনে অনড় অবস্থান নেয়। তাদের যুক্তিÑ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়। তারা মনে করে, একসঙ্গে ভোট হলে গুরুত্ব হারাবে গণভোট।

বিএনপির প্রস্তাব :

নির্বাচন ও গণভোট একসাথে :

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় বাকি। এর আগে গণভোট আয়োজন বাস্তবসম্মত নয়।’ তিনি প্রস্তাব দেন, ‘একটি প্রজ্ঞাপন বা বিশেষ আদেশ জারি করে নতুন আইন প্রণয়ন করে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। সেই গণভোটে জনগণের সমর্থন পেলে আগামী সংসদকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তার মতে, ‘সংসদের স্বাধীনতা বজায় রেখে সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সময় নির্ধারণ না করে বলা উচিত, যথা শিগগির সম্ভব বাস্তবায়ন করা হবে।’

জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান :

আগে গণভোট, পরে নির্বাচন :

জামায়াতের প্রতিনিধি হামিদুর রহমান আযাদ জানান, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গণভোট আয়োজন সম্ভব। আইনজীবী শিশির মনির বলেন, একটি আদেশ জারি করে তাতে জুলাই সনদ সংযুক্ত করে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। তিনি সংসদকে দুটি ক্ষমতাÑ সাধারণ ও গাঠনিক ক্ষমতার দেওয়ার কথা বলেন, যাতে সংস্কার টেকসই হয়।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, গণভোটের আগে আদেশ জারি ও সংসদকে গাঠনিক ক্ষমতা না দিলে ভবিষ্যতে সংস্কার প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

আলোচনায় সমঝোতার আহ্বান :

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বিএনপি ও জামায়াতকে বসে সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত বসেন। কথা বলে আপনারা ঠিক করেন। নিজেরা যদি ঠিক করে ফেলতে পারেন, তাহলে উই ক্যান গো ফর ইলেকশন।’ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও গণসংহতি আন্দোলনের নেতারা প্রস্তাব দেন, দলগুলো যেন নিজেরা বসে ভিন্নমত কমিয়ে আনার চেষ্টা করে।

মতামত সমন্বয় করে সরকারকে জানাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর দেওয়া মতামত সমন্বয় করে কমিশন আগামী দু-এক দিনের মধ্যে আলোচনা করে সরকারকে পরামর্শ দেবে। তিনি জানান, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কমিশন জুলাই সনদ প্রণয়নের এ পর্যায়ে এসেছে তার একটি বিশেষ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হবে এবং খুব দ্রুতই কমিশন সংশ্লিষ্ট দল ও জোটগুলোকে এ বিষয়ে অবহিত করবে। সেইসঙ্গে আগামী ১৫ অক্টোবর কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘আগামী ১৫ অক্টোবর কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে কমিশনের বেশকিছু কাজ রয়েছে। ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’-এর ব্যাপারে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। আশা করছি, কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এর স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারব।’

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের অক্টোবরের শুরুতে সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব জমা দেয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ। প্রথম ধাপে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা, আর দ্বিতীয় ধাপে সম্মিলিত আলোচনা হয়। দুই পর্বের আলোচনায় মোট ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। তবে বাস্তবায়নের পথ নির্ধারণে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়নি।