বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ১২:০২ এএম

এই নির্মম মৃত্যুর শেষ কোথায়

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ১২:০২ এএম

এই নির্মম মৃত্যুর শেষ কোথায়

রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো আবারও ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এবার মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে একটি পোশাক কারখানা ও একটি কেমিক্যাল গোডাউনে লাগা আগুনে অঙ্গার হয়েছে ১৬ প্রাণ। নিহতদের ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে তিনজনকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় ওই এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। আপনজনের খোঁজ না পেয়ে ঘটনাস্থলে ভিড় করেছেন উদ্বিগ্ন স্বজনরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে র‌্যাব-পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। অগ্নিকা-ে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এই আগুনের সূত্রপাত ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নির্বাপণের কাজ শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট বিকেল ৪টার দিকে পোশাক কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, তবে রাত সাড়ে ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

জানা গেছে, শিয়ালবাড়ির বিউবিটি ইউনিভার্সিটির সামনে আনোয়ারা ফ্যাশন ও তার পাশে থাকা টিনশেড ঘরে কেমিক্যাল গোডাউনে এই অগ্নিকা- ঘটে। পোশাক কারখানার দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলার বিভিন্ন স্থান থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। প্রাথমিকভাবে তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। তবে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে ফায়ার সার্ভিস। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করার জন্য কাজ করছে সিআইডির ক্রাইম সিন ও কেমিক্যাল ল্যাব বিশেষজ্ঞরা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ১২টি ইউনিট কাজ করেছে। ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাসেই শ্রমিকদের প্রাণ ঝরেছে। তারা কারখানার নিচে নামতে পারেনি। ছাদেও যেতে পারেনি। ছাদের গেট বন্ধ ছিল। জনবহুল এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউন দেওয়ার ছাড়পত্র ছাড়াই চলছিল তাদের কর্মকা-। এমনকি ফায়ার সেফটিও ছিল না ভবনে। ঘটনার পর মালিকপক্ষের হদিস মিলছে না।

এদিকে অগ্নিকা-ের খবরে ঘটনাস্থলে ভিড় জমে শত শত উৎসুক মানুষের। তাদের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পোহাতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। সময় গড়ানোর সঙ্গে উদ্বিগ্ন স্বজনদের ভিড় বাড়ে কারখানার সামনে। নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে ওই এলাকার পরিবেশ। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সহযোগিতায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যোগ দেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা উদ্ধার ও উৎসুক জনতাকে নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। পাশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরাও উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন। ঘটনাস্থল ও আশপাশের হাসপাতালগুলোয় নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে ফিরছেন অসংখ্য মানুষ। অনেকে প্রিয়জনের ছবি হাতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। পোশাক কারখানার ভেতরে কাজ করা অনেক শ্রমিকের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি।

এক স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একের পর এক এই নির্মম মৃত্যু আর কত দেখবে ঢাকাবাসী। নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বেইলি রোডের থেকে রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে এ ভয়াবহ অগ্নিকা- এর থেকে কি ঢাকাবাসীর রেহাই নেই? এত মৃত্যুর শেষ কোথায়? আজও ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরেনি। প্রতিটি ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর হইচই শুরু হয়। নিয়ম-অনিয়ম নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। প্রশাসনের কর্তারা নড়েচড়ে বসেন। ঘটনার কারণ উদঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর আলোর মুখ দেখে না।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, পোশাক কারখানার নিচতলায় ‘ওয়াশ ইউনিট’ রয়েছে। সেখানে প্রথম আগুন লাগে। সেই আগুন পাশের রাসায়নিকের গুদামে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আগুন চারতলা পোশাক কারখানার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর কারখানা থেকে শ্রমিকেরা নানাভাবে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই অনেকে আটকা পড়েন।

কেমিক্যাল গোডাউনের পাশেই পাঁচতলা ভবনের একজন ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান জানান, তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল ভবনটির দ্বিতীয়তলায়। তিনি বলেন, এই পাঁচতলা ভবনের মধ্যে তিনটা কারখানা আছে। প্রিন্টি এবং ডিজাইনের এবং নিটিংয়ের একটি কারখানা। আগুনের খবর পেয়েই তিনি তার শ্রমিকদের নিয়ে বের হয়ে আসেন। তবে তিনতলায় যে শ্রমিকরা কাজ করতেন। সেখানে অনেকে আটকে থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কেমিক্যাল গোডাউনে সাত থেকে আট ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে। টঙ্গীতে যে বিস্ফোরণ হয়েছিল, ওই কেমিক্যালগুলোর সঙ্গে এখানকার কেমিক্যালের মিল আছে। সে জন্য আশপাশের লোকজনকে সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছে। এবং যেকোনো সময় ফের বিস্ফোরণ হতে পারে।

ভবনটির বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি বলেন, ‘হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ পেলাম। মুহূর্তেই আমাদের জানালা গ্লাসগুলো সব ভেঙে আমাদের ফ্লোরের ভেতর পুরে ঢুকে গেল। পুরো ফ্লোরটা পাঁচ-সাত সেকেন্ডের ভেতরে অন্ধকার হয়ে গেল। গ্যাসে বা ধোঁয়ায় যেটাই হোক, মানে আর নিশ^াস নেওয়ার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। আমরা দোতলা থেকে যে নিচে বের হবো এ অবস্থা ছিল না। আমরা চার-পাঁচজন ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে ওখানে পাঁচ মিনিটের মতো ছিলাম। তারপরে দেখছি, আর ওখানে টিকতে পারছি না। পরে এই অন্ধকারের ভেতরে দ্রুতই বের হয়ে আসছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভবনের গেটের নিচে আমার মোটরসাইকেল ছিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের হয়ে দেখি, পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আমাদের ভবনের পাশে একটা ওয়াশ, বাম পাশেও একটা ওয়াশ, ডান পাশেও ওয়াশ। আবার সামনে অপজিটে একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। তার পাশে একটা ওয়াশ। ওয়াশের বয়লার চালানোর জন্য তারা আলাদা বড় গ্যাস সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করে। ওনাদের একেকটা গাড়িতে ৭-৮টা গ্যাস সিলিন্ডার ভ্যানগাড়ির সিস্টেমে সাজানো থাকে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আহত তো অনেকেই হয়েছে। তবে অনেকেই বের হতে পারছে না। হয়তোবা কয়েকজনের মানে তিনতলার যে লোকগুলো ছিল, তাদের সব তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

গতকাল রাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অগ্নিকা-ে উদ্ধার হওয়া ১৬টি মরদেহই পোশাক কারখানার ভবন থেকে পাওয়া গেছে। তবে তাদের কারো পরিচয়ই জানা যায়নি। নিহতদের চেহারা দেখে কিংবা অন্য কোনোভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। ‎ডিএনএ টেস্ট ছাড়া তাদের পরিচয় জানা সম্ভব নয়। একজন ভলান্টিয়ার আহত হয়েছেন। তবে এ দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কেউ আহত হননি। ‎

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, এই অগ্নিকা-ের ফলে যে বিস্ফোরণটি হয়েছে, তাতে যে সাদা ধোঁয়া বা গ্যাস উৎপন্ন হয়েছিল, তা অত্যন্ত বিষাক্ত। আগুন লাগার প্রথম দিকেই ফ্ল্যাশ ওভার হয়েছিল এবং আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষাক্ত গ্যাসের কারণে আকস্মিকভাবেই হয়তো নিহতরা সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মারা গেছেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, মরদেহগুলো দোতলা এবং তিনতলা মিলিয়ে বিভিন্ন কর্নারে পাওয়া গেছে। তারা নিচেও নামতে পারেননি এবং ওপরে ছাদে যাওয়ার যে গ্রিলের দরজা ছিল, সেটি দুটি তালা দিয়ে বন্ধ ছিল, সে কারণে ওপরেও যেতে পারেননি। ফলে দুই ও তিনতলায় অধিকাংশ মানুষ মারা যায়।

রাত সাড়ে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস জানায়, তাদের ১২টি ইউনিট এ কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে এবং এখনো কাজ করছে। গার্মেন্টস অংশের আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। কিন্তু কেমিক্যাল গোঠাউনের আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণ হয়নি। অগ্নিনির্বাপণের কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, গোঠাউনটি এখনো সেফ বা নিরাপদ না। সেখানে এখনো শিখা রয়েছে এবং ধোঁয়া উঠছে। এই আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে আরও সময় লাগতে পারে।

ওই গোডাউনে কী কী ছিল জানতে চাইলে সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, যতটুকু জানা গেছে, গোডাউনে ছয়-সাত ধরনের কেমিক্যাল ছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে ও সার্চিং কার্যক্রমে হিউম্যানলেস টেকনোলজি, যেমন-লুপ ৬০ ড্রোন এবং গ্রাউন্ড মনিটর ব্যবহার করা হচ্ছে। আগুন নেভানোর জন্য সাধারণত পাউডার, ওয়াটার, এনজাইম এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডও ব্যবহার করা হচ্ছে। মরদেহ বের করার জন্য কিছুক্ষণ সার্চিং অপারেশন বন্ধ রাখা হয়েছিল বলেও জানান তিনি। ‎

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গোঠাউন থেকে ছড়ানো আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ৭১ জন। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৭ জন প্রাণ হারান। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ বহুতল ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের গত মাসে টঙ্গীতে একটি কেমিক্যালের গোডাউনে আগুন নিভাতে গিয়ে প্রাণ হারান ফায়ার সার্ভিসের ৫ জন।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!