বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা ও শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৫, ১২:১৫ এএম

শিয়ালবাড়ী অগ্নিকাকাণ্ডের ট্র্যাজেডি

রূপনগরের বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস

মেহেদী হাসান খাজা ও শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৫, ১২:১৫ এএম

রূপনগরের বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস

  • রাসায়নিক গুদামটি অবৈধ, তিনবার নোটিশও দেওয়া হয়েছিল: ফায়ার সার্ভিস
  • তদন্ত কমিটি গঠন, আর্থিক সহায়তার ঘোষণা
  • ২৮ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে

‘কারখানার নিচতলার ওয়াশ সেকশনে হঠাৎ বিকট শব্দ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তে ধোঁয়ায় ভরে যায় দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা। কেউ তেমন চোখে দেখতে পায় না। মানুষগুলো চোখ বন্ধ করে ওপর-নিচে দৌড়াদৌড়ি করছিল। আমি কোনো মতে গড়াতে গড়াতে কেমনে যে বেঁচে গেলাম, নিজেই জানি না।’ কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর থানার শিয়ালবাড়ী এলাকায় ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে রক্ষা পাওয়া শ্রমিক নাজমুল হোসাইন। এ সময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের গার্মেন্টস কারখানা কর্তৃপক্ষ এই দুর্ঘটনার দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাদের আগে থেকেই ফায়ার সার্ভিস সতর্ক করলেও তারা সতর্ক হননি, বরং ক্ষমতা ও গায়ের জোরেই চলছিলেন। মিরপুরে এমন অসংখ্য কলকারখানা রয়েছে, সেগুলোতে যাতে এমন দুর্ঘটনা আর না ঘটে, এসব বন্ধ হোক। এ জন্য প্রসাশন ও সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই শ্রমিক। 

গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, স্বজনদের আর্তনাদ ছিল রূপনগরের শিয়ালবাড়ী এলাকার আগুন লাগার ঘটনাস্থলে। ফায়ার সার্ভিস ও বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থলে গিয়ে জানায়, রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন এবং যে বিস্ফোরণ হয়েছে, তাতে অত্যন্ত বিষাক্ত সাদা ধোঁয়া বা টক্সিক গ্যাস উৎপন্ন হয়েছিল। আগুন লাগার প্রথম দিকেই ফ্ল্যাশ ওভার হয়েছিল এবং আগুন বাতাসের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ জন্য এসব এলাকায় বসবাসকারীদের দরজা-জানালা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  

গত মঙ্গলবার লাগা এই ভয়াভহ আগুন গতকাল বুধবার ২৮ ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। গতকাল বিকেলে আগুন নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেন ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম। তিনি জানান, ‘বুধবার (গতকাল) বিকেলে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সর্বশেষ আমাদের পাঁচটি ইউনিট কাজ করেছে।’

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, মিরপুরের রাসায়নিক গুদামটি অবৈধ, তিনবার নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। কেমিক্যাল গুদামের আগুন বাতাসে ছড়িয়ে বিষাক্ত গ্যাসে রূপান্তর হয়, যার কারণে দমকলবাহিনীর সদস্যদের এটি নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ সময় লেগেছে। সেই সঙ্গে আগুন নিভানোর সময় কেমিক্যালের ধোঁয়ায় ফায়ার ফাইটারসহ অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

ফায়ার সার্ভিস ও কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, মৃতদেহগুলো দোতলা ও তৃতীয় তলা মিলিয়ে বিভিন্ন কর্নারে পাওয়া গেছে। সেখানে বাতাস জমে ছিল। তা ছাড়া ভবনটির ছাদের দরজা বন্ধ থাকায় পোশাকশ্রমিকেরা ছাদে যেতে পারেননি। অন্যদিকে, নিচে ধোঁয়া থাকায় তারা নামতেও পারেননি। ফলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় অধিকাংশ মানুষ মারা যান। আগুনের ধোঁয়ার তীব্রতায় কারখানার ভেতরে থাকা ব্যক্তিরা নিচে নামতে পারেননি।  

তদন্ত কমিটি গঠন, আর্থিক সহায়তার ঘোষণা:

রূপনগরের শাহআলম কেমিক্যাল গোডাউন এবং এর পাশের একটি পোশাক প্রিন্টিং কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় সাত সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়। নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে ২ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা এবং আহত শ্রমিকদের চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে। গতকাল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

আগুনের ভয়াবহতা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তরিকুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক। তরিকুলের দাবি, ‘আগুন লাগার পর যদি অন্যদের মতো দোতলায় থাকতাম, তাহলে আমিও মারা যাওয়াদের মধ্যে একজন হতাম। আমার ভাগ্য নিয়তি ভালো রেখেছেন, কিন্তু আমার সঙ্গে যারা কাজ করত, তারা আগুনে পুড়ে মারা গেছে এমন খবর শুনে আমি কোনোভাবেই স্থির হতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘আমার সহকর্মীরা মারা যাওয়ার মূল কারণ হলো কারখানার মালিক। আমাদের মালিক এই দুর্ঘটনার জন্য একান্তই দায়ী। আমরা মালিক কর্তৃপক্ষের বিচার চাই। মূলত তাদের গাফিলতিতে এমন ধরনের ট্র্যাজেডি দেখতে হলো আমাদের।’

মেয়ের পাসপোর্ট সাইজের ছবি হাতে আহাজারি করছেন সুরমা বেগম। তার মেয়ে নার্গিস আক্তার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আনোয়ার ফ্যাশনে অপারেটর হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সুরমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আর্মি, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস কেউ কিছু বলছে না। ভিতরে কী অবস্থা, মাইয়াডার কিসু হইল কি না, কিছুই জানি না। আমার মায়াডা কোথায় গেল?’ তিনি জানান, এসএসসি পরীক্ষার পর নার্গিস নিজের চেষ্টায় চাকরি নেয়। মেয়েকে তিনিই বাসায় সেলাই শেখান।

অগ্নিকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী আফজাল সরকার। তিনি পাশের শোরুমে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন। আফজাল বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দে প্রথমে আগুন লাগে কারখানার নিচতলার ওয়াশ সেকশনে। মুহূর্তের মধ্যেই ওপরের তলাগুলো ধোঁয়ায় ভরে যায়।  মানুষগুলো দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে আর ওপরে-নিচে উঠতে থাকে।’ একাধিক স্বজন ও শ্রমিকেরা অভিযোগ করে বলেন, ভবনের ছাদে ওঠার দুটি দরজায় তালা দেওয়া ছিল। ফলে কেউ ওপরে গিয়ে রক্ষা পাননি।  

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামের আগুন পুরোপুরি নেভেনি। ঘটনাস্থল থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও কেমিক্যালের উপস্থিতির কারণে পুরোপুরি নির্বাপণে সময় লাগছে। এদিকে মঙ্গলবারের মতো নিখোঁজদের খুঁজতে বুধবার পুড়ে যাওয়া ‘রাইজিং ফ্যাশন’ কারখানার শ্রমিক ও হতাহতের স্বজনেরা ঘটনাস্থলে ভিড় করতে থাকেন। কেউ আসেন সহকর্মীদের খোঁজে, কেউ দেখতে যে কারখানা আবার চালু হবে কি না।

রাসায়নিক গুদামটি অবৈধ, তিনবার নোটিশও দেওয়া হয়েছিলÑ ফায়ার সার্ভিস: ফায়ার সার্ভিসের তৈরি করা অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ীতে আগুনে পুড়ে যাওয়া রাসায়নিক গুদাম আলম ট্রেডার্সও ছিল বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ডে মেইটেন্যান্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম। গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তিনি। তাজুল ইসলাম আরও জানান, সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি তিনবার ওই গুদামে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। এখন ওই গুদাম অভিযান চালানোর পর্যায়ে ছিল। ভবনটির দোতলায় স্মার্ট প্রিন্টিং নামের একটি কারখানায় টি-শার্ট প্রিন্ট করা হয়। আর তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আরএন ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানা আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।  

রাসায়নিকের তেজস্ক্রিয়তার কারণে গুদামে সার্চ অপারেশন চালানো যায়নি বলেও জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, আরও ৩৬ থেকে ৭২ ঘণ্টা লাগতে পারে। এখন রাসায়নিক দ্রব্যগুলো পানি ছিটিয়ে অপসারণ করা হচ্ছে। এটা একটা রাসায়নিক গুদাম এবং এখানে ছয়-সাত ধরনের বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে। তবে কী ধরনের রাসায়নিক বা এগুলোর মাত্রা কী, তা এখনো যাচাই-বাছাই করা যায়নি। পুরো গুদাম বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যে ভরা। পানি ছিটিয়ে এসব রাসায়নিক পরিষ্কার করা হচ্ছে। কাজটি সময়সাপেক্ষ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সিস্টেমেটিক কাজ করছি।  টেকনোলজি অ্যাপ্লাই করছি। ড্রোন দিয়ে দেখছি এবং আমরা বোঝার চেষ্টা করছি।’ আলম ট্রেডার্সের ভবনটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গুদাম অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লম্বা সময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে এই ভবনের পিলারগুলো অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে রাজউক, ভবন বিশারদ, যারা দায়িত্বশীল ব্যক্তি রয়েছেন, তারাই বলতে পারবেন যে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে। এখানে যেকোনো অভিযান চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকি এড়াতে নিরাপত্তার সঙ্গে ধাপে ধাপে কাজ করা হচ্ছে।’ ভেতরের অবস্থার বিষয়ে তাজুল ইসলাম জানান, ‘আলম ট্রেডার্সের মূল দরজায় তালা মারা ছিল। হাইড্রলিক স্প্রেডার ও কাটার দিয়ে এটাকে কেটে তারপর খুলতে হয়েছে। সুতরাং ধারণা করা হচ্ছে যে এখানে হয়তো মানুষ ছিল না।  তার পরও সার্চ অপারেশন না চালানো পর্যন্ত বলা যাবে না, এখানে মানুষ ছিল কি ছিলেন না।’

অগ্নিকা- এলাকায় সতর্কতা বসতবাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ রাখার নির্দেশনা: ফায়ার সার্ভিস জানায়, ভেতরে জমে থাকা রাসায়নিক থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া মারাত্মকভাবে টক্সিক এবং প্রাণঘাতী হতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, ‘কেমিক্যালের ধোঁয়া ও ক্লোরিন গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, যা মানুষের ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করে।  ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এটি বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।’  তিনি আরও জানান, ‘সকালে ফায়ার সার্ভিসের একটি বিশেষ দল সুরক্ষা পোশাক (কেমিক্যাল স্যুট) পরে গুদামের প্রধান ফটক খুলতে সক্ষম হলেও গুদামের ভেতরে এখনো প্রবেশ সম্ভব হয়নি। সেখানে এখনো প্রচুর সাদা ধোঁয়া জমে আছে।’

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিয়ালবাড়ী এলাকার আশপাশে ৩০০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের দরজা-জানালা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় কয়েকটি পোশাক কারখানাও সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে শ্রমিকেরা ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত না হন। তা ছাড়া এই ধোঁয়ার সঙ্গে যে টক্সিক গ্যাস আছে, তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে এমন ক্ষতি করতে পারে, যা তৎক্ষণিক বোঝা যাবে না। আমরা অনুরোধ করছি, কেউ যেন আশপাশে ভিড় না করে এবং সবাই যেন মাস্ক ব্যবহার করে।’

এদিকে প্রসাশনের এমন সতর্কের পর জ¦লন্ত রাসায়নিকের তীব্র গন্ধে আশপাশের এলাকার মানুষ, গার্মেন্টস শ্রমিক ও দোকানদারদের অনেককেই এলাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। ঘটনার সংবাদ সংগ্রহে আসা সাংবাদিক ও উদ্ধারকর্মীদের মুখে মাস্ক পরে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!