* ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকলে এত বড় দুর্ঘটনা হতো নাÑ ফায়ার সার্ভিস
* পুড়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম
* তদন্তে নাশকতাসহ কোনো কিছুই উড়িয়ে দেব নাÑ বিমান ও পর্যটন উপদেষ্টা
* তিন দিন অতিরিক্ত ফ্লাইটের মাশুল ও খরচ মওকুফ
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও অবহেলায় ক্ষুব্ধ আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্টসহ সংশ্লিষ্টরা। কার্গো ভিলেজের আগুনে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজিএমইএ নেতারা। তারা জানান, আগুনে শত শত কারখানার পণ্য পুড়েছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর। কোনো কোনো ওষুধ কোম্পানির ক্ষতি শতকোটি টাকার বেশি বলে জানান সিএন্ডএফ কর্মীরা। বিমা সুরক্ষা না থাকায় বাণিজ্যিক পণ্য আমদানিকারকেরাও পড়েছেন বড় ক্ষতির মুখে। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের মতে, কার্গো ভিলেজে ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম না থাকায় এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছে সরকার। ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ বিমান।
এদিকে বিমান ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ঘটনা তদন্তে নাশকতাসহ সবকিছুই আমলে নেওয়া হবে। মূলত আমদানি কার্গোতে পণ্যগুলো একত্র হয়। সেগুলো পুড়ে ধ্বংস হয়েছে। আগুনে কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা অর্থমূল্য ও ওজনের ভিত্তিতে নির্ধারণের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি খাতভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতিরও হিসাব করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসকে অনুমতি না দেওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব হয়েছেÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার অভিযোগটি সঠিক নয়। বিমানবন্দরের ভেতরে অগ্নিনির্বাপণে যারা ছিলেন, তারা ঘটনার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই কাজ শুরু করেছেন। আপনারা জানেন, এটি একটি কেপিআইভুক্ত এলাকা, এখানে অগ্নিনির্বাপণের নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে।’
কামাল উদ্দিন নামে একজন অমদানিকারক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্রের অবহেলা আর গাফিলতির কারণে আজ হাজারো ব্যবসায়ী পথে বসে গেছেন। পূর্বেও দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে আগ্নিকা- ঘটেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই সময়েও ছুটির দিনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল। শনিবারও শিফটিংয়ের সময় যখন লোকজন কম ছিল তখন আগুন লাগে। এসব ঘটনা কি শুধুই কাকতালীয়, নাকি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে কোনো নাশকতা, তা-ও তদন্ত করে দেখার দাবি করেন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে সেই সঙ্গে তিনি অরও উল্লেখ করেন, ফেসিস্ট অওয়ামী লীগের সময়ের অনেক কর্মী এখনো এই বিমানবন্দরে কাজ করছেন।
এফটেক ইন্ডাস্ট্রি পার্কের সাপ্লাই বিভাগের কর্মকর্তা মো. ফেরদৌস বলেন, আমদানি কার্গো ভিলেজে তাদের ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ছিল। সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা এবং যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে না পারায় এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।
ডেবিনিয়ার গ্রুপের এয়ারপোর্ট সেকশনের কর্মী হযরত আলী বলেন, গেট-বিতে তাদের ১৩টি শিপমেন্ট ছিল। সেখানে ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার পণ্য ছিল। এ ছাড়া কুরিয়ারে ছিল এক থেকে দেড় কোটি টাকার পার্সেল। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ প্রতি কেজি পণ্যের জন্য দৈনিক ৬ টাকা ১৫ পয়সা হারে চার্জ নেয়। কিন্তু আমদানি করা পণ্যের রক্ষণাবেক্ষণে তারা কোনো দায়িত্ব নেয় না। বছরের পর বছর বৃষ্টিতে পণ্য নষ্ট হয়। তার মাশুল গুনতে হয় আমদানিকারকদের। শনিবার অগ্নিকা-েও তারা একইভাবে গাফিলতি আর দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিতে বিলম্বের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং এফ কে ট্রেড এজিন্সি নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অংশীদার বেলাল উদ্দিন বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, অগুনে তার কয়েক কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। কীভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে পুনরায় ব্যবসায় ফিরবেন, তা তিনি জানেন না। তার মতো এরকম অনেকেই আছেন গভীর অন্ধকারে।
তিনি বলেন, ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। কতটুকু পণ্য পুড়েছে, কতটুকু রক্ষা করা গেছে, সেই হিসাব কষে ক্রেতা ধরে রাখতে এখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা সেই উদ্যোগ দেখতে পারছি না।
ঘটনাস্থলে বিপরীত দিকে দীর্ঘদিন ধরে পান-সিগারেট বিক্রি করেন সেলিম মিয়া (ছদ্মনাম)। প্রতিদিনকার মতো অগ্নিকা-ের সময় তিনি সেখানেই ছিলেন। সেলিম মিয়া বলেন, প্রথমে সামান্য কিছু সাদা ধোঁয়া দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরই দাউদাউ করে অগুন জ¦লে ওঠে। প্রায় সাথে সাথেই বিমানবন্দরের ভেতরে থাকা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি থেকে পানি দেওয়া শুরু হয়। এরপর সাইরেন বাজিয়ে বেশ কয়েকটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি অসে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ সেগুলো গেটের বাইরে অপেক্ষা করলেও গেট খোলা হয়নি। এমনকি পানির পাইপও প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আধা ঘণ্টার মধ্যেই আগুন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স: বাধাপ্রাপ্তির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অবশ্যই আগুন ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকা উচিত ছিল। গতকাল রোববার বিকেলে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের সামনে ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রমের সমাপনী ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে যদি ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকত, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা হতো না। এমন কোনো ব্যবস্থা আমরা পাইনি। ভবিষ্যতে এখানে এ ধরনের সিস্টেম স্থাপন করা জরুরি।
তিনি বলেন, কার্গো ভিলেজের কাস্টমস হাউসের অংশে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ভবনটি বিভিন্ন ছোট কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা ছিল এবং ভেতরে প্রচুর দাহ্য ও হ্যাজার্ডাস উপাদান ছিল। এ জন্য অকুপেন্সি লোড অনেক বেশি ছিল এবং এ কারণেই আগুন নির্বাপণে অনেক বেশি সময় লেগেছে।
তিনি আরও বলেন, ভবনটি স্টিল স্ট্রাকচারের তৈরি। এসব ধাতব অংশ আগুনের তাপ শোষণ করে রেখেছিল, এখনো তা ধীরে ধীরে তাপ ছাড়ছে। এ জন্য বাইরে থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছ। তবে আগুনের কোনো শিখা জ¦লন্ত নেই বা নতুন আগুনেরও আশঙ্কা নেই। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট সতর্ক অবস্থানে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত ধোঁয়া দেখা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কিছু বক্তব্যে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের বিলম্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছেছি। কোথাও থেকে কোনো বাধা বা বিলম্বের ঘটনা ঘটেনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার টিম ও আমাদের ফায়ার সার্ভিস পৃথকভাবে দায়িত্ব পালন করে। এখানে ফায়ার সার্ভিসের উপস্থিতিতে নিয়মবিরোধী কিছু হয়নি।’ ভবনের স্থিতিশীলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগুনের উচ্চ তাপমাত্রায় কিছু কলামে ফাটল ধরেছে, ভবন কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে আমরা কাজ করেছি বলে বুঝতে পারছি এটি এখনো আংশিক স্থিতিশীল। তবু কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কাঠামোগত জরিপ করে ঝুঁকি নিরূপণ করা। তিনি আরও জানান, আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে, তা তদন্তাধীন। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা বিস্তারিত যাচাই করে প্রতিবেদন দেবে।’
ঘটনাস্থলে থাকা ওষুধ, ফার্মাসিউটিক্যাল ও অন্যান্য পণ্য থেকে কিছু বাই-প্রোডাক্ট কেমিক্যাল তৈরি হতে পারে বলে ধারণা দেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক। তিনি বলেন, তবে এটা মিরপুরের কেমিক্যাল গোডাউনের মতো উচ্চ তেজস্ক্রিয় কোনো ঘটনা নয়। বাতাসে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিপজ্জনক মাত্রা পাওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের দুই সদস্য এবং আনসারের কয়েকজন সদস্য হালকা আহত হয়েছেন বলে জানান তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, সিগনিফিকেন্ট বা বড় ধরনের কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আমরা আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ ঘোষণা করছি। ধোঁয়া কিছুটা থাকবে, তাই চারটি ইউনিট এখানে প্রস্তুত থাকবে ভবিষ্যতের যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায়।
পুড়ে গেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম: এদিকে অগ্নিকা-ের ঘটনায় পুড়ে গেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা বেশ কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। এসব সরঞ্জাম গতকাল কার্গো ভিলেজ থেকে খালাস হওয়ার কথা ছিল। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আনা হয়। বিমানবন্দরে আমদানি পণ্য খালাসে সিঅ্যান্ডএফের কাজ করে মমতা ট্রেডিং কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মমতা ট্রেডিংয়ের কাস্টমস সরকার বিপ্লব হোসাইনের জানান, ছয় দিন আগে রাশিয়া থেকে সাতটি শিপমেন্টের মাধ্যমে প্রায় ১৮ টনের মতো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এসেছিল। এসব পণ্য খালাসের জন্য পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে এনওসি (অনাপত্তিপত্র) নিতে হয়। সেই এনওসি নিতে দেরি হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পণ্য খালাস করা যায়নি। রোববার খালাস হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তার মধ্যেই এসব পণ্য আগুনে পুড়ে গেছে।
আইএসপিআর: এদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমন্বিতভাবে অগ্নিনির্বাপণ এবং উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করে। অগ্নি নির্বাপণকালে রাসায়নিক পদার্থের ধোঁয়া ও আগুনের তীব্রতায় ১০ জন আনসার সদস্য, ৩ জন ফায়ার ফাইটার এবং ১ জন পুলিশ সদস্য প্রবল শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে সিএমএইচ ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন