ঢাকা শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫

ইসিকে বিএনপির প্রস্তাব

ইসলামী ব্যাংকসহ বিতর্কিত ব্যক্তিরা ভোটের দায়িত্বে নয় 

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২৫, ১১:৫৭ পিএম

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ব্যাংক বা ইসলামপন্থি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাউকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব না দিতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) লিখিত দাবি জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল বৃহস্পতিবার আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বা পোলিং পারসোনাল তথা প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবার কাছে চিহ্নিত এমন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রদান করা যাবে না। যেমনÑ ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা ইত্যাদি।’ উল্লেখযোগ্য যে, ইতিমধ্যে ইসলামী ব্যাংকে সারা দেশে প্রায় ৫,০০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল করেছে এবং এসব শূন্য পদে তড়িঘড়ি করে দলীয় লোকজন নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে জনশ্রুতি রয়েছে।

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে মঈন খান বলেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের কাছে বেশ কিছু দাবি জানিয়েছি আমরা। এর মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের শতভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের জন্য এখনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে এই সরকারের ও নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় ভূমিকা পালন করার কথা আমরা বলেছি। আমাদের মোট ৩৬টি দাবি ছিল। যেগুলো আমরা জানিয়েছি ইসিকে। এখন ইসি পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।’ এ সময় এনসিপির প্রতীক জটিলতা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন জুলাই সনদেও এখন পর্যন্ত এনসিপি স্বাক্ষর করেনি। সব বিষয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে এমনটা কখনো কাম্য নয়। বিরোধী মত না থাকলেও তো ‘বাকশাল’ হয়ে যাবে। আশা করছি, তারা রাজনৈতিকভাবেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’ পূর্বের বছরগুলোর মতো কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপির নির্বাচন করার সম্ভাবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশে^র সব দেশেই জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার বা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে জোটবদ্ধ হওয়ার নজির রয়েছে। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। তবে এখনই এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

ইসির কাছে বিএনপির তুলে ধরা ৩৬ দাবির মধ্যে অন্যতমÑ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে মাঠ প্রশাসনকে সম্পূণ ঢেলে সাজাতে হবে। যেমনÑ ডিসি, ইউএনও, এসপি, ওসি এবং ক্ষেত্রমতে কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। উল্লেখ্য যে, জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে এ ধরনের পুনর্বিন্যাস একটি রুটিন প্রক্রিয়া, যা অবশ্য করণীয়, বিগত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের অবৈধ নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সব বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের কোনোরূপ নির্বাচনি দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না, রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রশাসনের অফিসারদের পাশাপাশি সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা (ইলেকশন সার্ভিস) কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে দক্ষ, সৎ, অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচনের সমগ্র প্রক্রিয়ায় জড়িত বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব কর্মকর্তার বদলি, পদায়ন, অবস্থান, দায়িত্ব ও তাদের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণের ভার নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে নিতে হবে।

সব ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ পূর্ব থেকে সামরিক বাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচনকালীন সময়ে অনিয়ম রোধে কমিটি গঠন ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বর্তমানে বিধান বলবৎ রয়েছে। নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালন, অবলোকন এবং নির্বাচনকে জনগণের কাছে দৃশ্যমান, বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বিচার বিভাগীয় ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করতে হবে, ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ অবাধ, নির্বিঘœ, স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান করার জন্য ভোটকেন্দ্রের গোপনীয় কক্ষের কার্যক্রম ব্যতীত ভোটকেন্দ্রের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ দৃশ্য বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির নিমিত্তে সিসি ক্যামেরা সংস্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে, নির্বাচনি সময়সূচি ঘোষণার সাথে সাথে প্রত্যেক জেলার জেলা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ে এবং প্রত্যেক উপজেলা/থানায় উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার কার্যালয়ে একটি করে অভিযোগ নিরসনকেন্দ্র চালু করতে হবে।

নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কোনো অভিযোগপ্রাপ্তির ১২ ঘণ্টার মধ্যে বা যত দ্রুত সম্ভব তা নিষ্পত্তি করে অভিযোগকারীকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে, জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি গঠিত হয়েছে। হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার ঠিক পূর্বমুহূর্তে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তড়িঘড়ি করে পয়লা নভেম্বরের মধ্যে নতুন করে নির্বাচন সম্পন্নের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়। এই কার্যক্রমের ফলে সারা দেশে শিক্ষক বা শিক্ষিকাদের বার্ষিক পরীক্ষার একাডেমিক কার্যক্রম, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, ভোটকেন্দ্রের নির্বাচনের প্রাক-কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একটি বৃহৎ কার্যক্রমে শিক্ষক বা শিক্ষিকা, অভিভাব কবা অভিভাবিকা তথা ভোটারদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি নির্বাচনসংক্রান্ত নির্দেশনা স্থগিত করতে হবে, নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বা পোলিং পারসোন্যাল তথা প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বমহলের নিকট চিহ্নিত এমন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রদান করা যাবে না।

দাবির মধ্যে আরও রয়েছেÑ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে জুলাই ২৪ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মীদের নামে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে দায়েরকৃত মিথ্যা, বানোয়াট ও গায়েবি মামলাসমূহ নির্বাচনি সময়সূচি জারির পূর্বেই প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বেই বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় প্রদত্ত সব অস্ত্র সরকারের কাছে জমা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অগণিত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সীমান্তপথে আসা অবৈধ অস্ত্র, নকল টাকা, কালো টাকার অনুপ্রবেশ বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে, সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে এবং দূতাবাসগুলোতে চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিল করতে হবে, নির্বাচন অবাধ, বিশ্বাসযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও পক্ষপাতহীন হতে হবে। ভোটারদের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে নির্বিঘেœ ভোটাধিকার প্রয়োগের অনুকূল পরিবেশ ও সূযোগ সৃষ্টি করতে হবে, নির্বাচনে সম্ভাব্য সব কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে, ভোটকেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগে অর্থশক্তি, পেশিশক্তি ব্যবহার ও প্রভাব প্রতিরোধ করতে হবে, নির্বাচনি এলাকায় বগিরাগত কোনো লোক নির্বাচনি প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না, নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের গৃহীত সাংবিধানিক শপথের প্রতি অনুগত থেকে নিরপেক্ষ ও সাহসী হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে।