পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর লাগাতার কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপিকে একপ্রকার ব্যস্ত রেখেছে। পাশপাশি নির্বাচনে বিএনপিকে ধরাশায়ী করে বিজয়ী হতে জোর প্রস্তুতি চালাচ্ছে দলটি। দেশের সর্বমোট ভোটারের ৭৩ দশমিক ২৮ শতাংশ নারী ও তরুণ ভোটারদের টার্গেট করে জোর প্রচারে নেমেছে জামায়াত। নারীদের ভোট নিশ্চিত করতে শহর-নগর-গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে দলের বার্তা পৌঁছাতে গ্রহণ করেছে বিশেষ কর্মসূচি। সম্প্রতি ডাকসু, জাকসু ও সবশেষ চাকসু ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে শিবিরের একচ্ছত্র বিজয়ে জামায়াতের আদর্শের ওপর তরুণদের আস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলেই মনে করেছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানান, আগামী নির্বাচনের ফল নির্ধারণে তরুণ ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এমন সমীকরণ সামনে দাঁড়িয়ে, তরুণ ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক নারী ভোটার; তাদের ভোট পেতে প্রায় এক বছর আগ থেকেই সরব কর্যক্রম চালানো হচ্ছে।
এদিকে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব, নি¤œকক্ষে পিআর পদ্ধতিসহ নানা ইস্যুতে রাজনীতির মাঠে বিএনপি-জামায়াতের বিপরীতমুখী অবস্থান স্পষ্ট। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনে প্রকাশ্যে মাঠে নেই আওয়ামী লীগ। দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেওয়াও অনিশ্চিত। ফলে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে থাকছে দলটির একসময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামী। দলটি তাদের নির্বাচনের প্রার্থী নির্দিষ্ট করে জোর প্রস্তুতি শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। দলের নেতারা আশা করছেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা কাক্সিক্ষত জয়লাভ করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ফল বদলাতে পারে তরুণ ভোটাররা। ফলে সব দলই তরুণদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার চালাবে। বর্তমানে দেশের মোট ভোটার ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫০৪ জন। যার মধ্যে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি ৪ লাখ ৭ হাজার ৯৮৬। নারী ভোটার রয়েছেন ৬ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৮১৯ জন। সুতরাং নারী এবং তরুণ মোট ভোটারের ৭৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। যেখান থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যে দল তরুণ এবং নারী ভোটারদের কাছে টানতে পারবে তারাই সরকার গঠন করবে। তারা বলছেন, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কৌশলে পা ফেলছে জামায়াত। রাজপথে আন্দোলন তাদের নির্বাচনি কৌশলের অংশ। সরকার ও বিশেষ একটি দলের ওপর চাপ রেখে ভোটের মাঠ সাজাচ্ছে জামায়াতের দায়িত্বশীলরা। ডাকসু-জাকসুর নির্বাচনে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দলটি কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনে ভালো করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না।
নারী ও তরুণদের আস্থা ছাত্রশিবির তথা জামায়াতে ইসলামীর ওপর বলে দাবি করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসুতে যুবসমাজ ছাত্রশিবিরের ওপর আস্থা রেখেছে। সব জায়গায় একই চিত্র। নারী ও তরুণদের আস্থা ছাত্রশিবিরের ওপর। এর প্রতিচ্ছবি জাতি আগামীতে দেখবে ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন, দুটো সমাজ ইসলামকে দারুণভাবে ধারণ করছেÑ একটি আমাদের যুবসমাজ, আরেকটি আমাদের মায়েদের সমাজ।
আসন্ন নির্বাচন ইস্যুতে দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জয়ের লক্ষ নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার মাধ্যমে পূর্ণ নির্বাচনি প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। তবে ৩০০ আসনে আমরা নির্বাচন করতে পারব না। এমনও হতে পারে, সমঝোতা করতে কমপক্ষে একশ আসন আমাদের ছেড়ে দেওয়া লাগতে পারে। অন্তত দুইশ আসনে আমরা নির্বাচন করব।
দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল। অতীতে সব গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ ও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল। সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনি প্রস্তুতি চলছে। জামায়াতের নেতৃত্বেই একটি জোটের দিকে এগোচ্ছে দল। শেষ মুহূর্তে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জোট হলে তাদের বেশকিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে এখনো বিষয়টি চূড়ান্ত নয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তরুণ ভোটারদের নিয়ে অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই আশাবাদী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সম্প্রতি দেশের বড় কয়েকটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল নিরঙ্কুশ জয়ে দলের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এখান থেকে বোঝা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও তরুণ ভোটাররা জামায়াতকে বেছে নেবেন। যা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, নারী ভোটাররা জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেন। নারীদের ভোট নিশ্চিত করতে আমরা নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। দেশের মানুষ এখন দলের নামে নয়, আদর্শ দেখে ভোট দেন বলেও জানান তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ছাত্রশিবির মার খেয়েই ক্যাম্পাসে টিকে ছিল। আমাদের ছাত্রদের মেরে থানায় দিয়ে আসত, সেখানেও নির্যাতন চলত। সেটার ফল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পেয়েছি। গলাবাজির রাজনীতি আর চলবে না। সেটা শিক্ষার্থীরা বুঝেছে। জাতীয় নির্বাচনেও এসব বিষয় চিন্তা করে মানুষ ভোট দেবেন।
এদিকে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির মাঠের দূরত্ব এবং ভোটের প্রচারের বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনে তারা জামায়াতে ইসলামীকেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছেন। সে জায়গায় দলের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে দলীয় প্রার্থী বাছাই, তৃণমূলে সভা-সমাবেশ এবং ধানের শীষের পক্ষে গণসংযোগ চলছে জোর গতিতে।
নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে বিএনপির। ইতোমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত মিত্ররা ২১৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা জমা দিয়েছে দলটির কাছে। সেখানে পরিষ্কারভাবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বা সমঝোতার কোনো ইঙ্গিত নেই। একইসাথে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শরিকদের (জামায়াত ছাড়া) ছাড় দেওয়া আসনগুলোর বেশির ভাগই এবারও ছাড় দেওয়া হতে পারে। কয়েকজনকে মৌখিকভাবে নিজ আসনে কাজ করার জন্য ইতোমধ্যে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে। তবে মিত্রদের মধ্যে যাদের এবার মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হবে না, তাদের সংসদের উচ্চকক্ষে মূল্যায়নের চেষ্টা করবে বিএনপি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিকদের ৫৮ আসনে ছাড় দিয়েছিল বিএনপি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ২২ আসন ও অন্যদের ৩৬ আসন ছাড় দেয় দলটি।
তবে প্রায় ২২ বছরের রাজনৈতিক মিত্র ও নির্বাচনি সঙ্গী দুটি দলÑ বিএনপি ও জামায়াত। সে সম্পর্ক এখন অতীত। ২০২২ সালে দল দুটির সম্পর্ক শিথিল হয় ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন বিএনপি ও জামায়াত পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি দল দুটিকে প্রতিপক্ষের জায়গায় এনেছে। দুটি দলের মধ্যে ভোটের মাঠে জামায়াতের অবস্থান যত শক্ত হবে, বিএনপির সঙ্গে বিরোধের জায়গাটাও তত শক্ত হবে। কেউ কেউ এটাকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও পলায়নপরবর্তী প্রেক্ষাপটে একটি নতুন রাজনৈতিক গতিপথের নির্দেশ হিসেবেও দেখছেন। একইসঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কার, পিআর পদ্ধতিসহ কিছু বিষয়ভিত্তিক মতবিরোধও তাদের এই মুখোমুখি অবস্থান শক্ত করেছেন বলে মনে করেন তারা। তারা মনে করেন, বর্তমান যে পেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে সেখান থেকে দুটি দলের একজোট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আর নেই।