বাংলাদেশের রাজনীতিতে একসময়ের জোটসঙ্গী বিএনপি-জামায়াত এখন মুখোমুখি। সাপে-নেউলে সম্পর্ক এখন তাদের মধ্যে। দেড় যুগ আগে পাঁচ বছর একসঙ্গে সরকারে থাকা দল দুটির নেতাদের মধ্যে বাগযুদ্ধ বর্তমানে রাজনীতির টক অব দ্য টাউন। শক্তিশালী শব্দের তির ছুড়ছেন তারা পরস্পরের প্রতি। তাদের এই প্রতিযোগিতার নেপথ্যে কী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা মূলত ক্ষমতার লড়াই। বাংলাদেশে গণভোট, জুলাই সনদ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধের মধ্যেই দেশজুড়ে নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীও এরই মধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে, সঙ্গে চলছে নির্বাচনি প্রচারও।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট করে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। সেই সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কাঁধে ভর করে সর্বোচ্চ ১৮টি আসন বাগিয়ে নেয় জামায়াত। জোটের খাতিরে যেসব আসন জামায়াতকে ছাড় দেওয়া হয়, সেসব আসনে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। ফলে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে ভোট করে সেই বৈতরণি পার হতে বেগ পেতে হয়নি জামায়াতকে। বিএনপির ভোট নিয়েই সহজ জয় পায় জামায়াত। তবে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সেই সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে। আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে হালে পানি দেয় জামায়াত। তবে আরেকটু পেছনে তাকালে দেখা যায়, ১৯৮৬ সালে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখলের জন্য স্বৈরাচার এরশাদের পাতানো নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ অংশ নেয়। তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে সেই নির্বাচনে যোগ দেয় জামায়াতও। জাতীয় পার্টি সরকার গঠন করলেও দুই বছর যেতে না যেতেই সরকারপতনের আন্দোলন শুরু হয়। সেবার বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে আন্দোলন করে। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট করে সরকারে যায় জামায়াত। বিএনপির সঙ্গে জোটে যুক্ত হওয়ায় আওয়ামী লীগ আর দ্বিতীয়বার ভুল করেনি জামায়াতকে নিয়ে। ফলে বিএনপির সঙ্গে দলটিকে থাকতে হয় দীর্ঘদিন। বিএনপি-জামায়াতের এই জোট বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী জোট হিসেবেই পরিচিত।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রধান দুই দল বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগের নির্বাচনি রেওয়াজ পুরোনো। এ দুই দলের মাঝে জাতীয় পার্টি থাকলেও স্বৈরচারের দায়ে ’৯০-পরবর্তী সময়ে কখনো রাজনীতির মাঠে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে টিকে থাকার লড়াই চালিয়েছে। তবে আওয়ামী সংশ্লিষ্টতার কারণেই বর্তমানে ফের অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে জাতীয় পার্টি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ীমী লীগ সরকারের পতন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়ন এবং দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ জামায়াত।
নির্বাচনি লড়াইয়ে তারা কতটা জায়গা করে নিতে পারবে, সেটিই হবে দলটির বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াতের জোট দীর্ঘদিন টিকে থাকলেও ক্ষমতা তথা সরকারে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দল দুটি এখন মুখোমুখি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ধীরে ধীরে দুই দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
এদিকে জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে জমায়াত ও নবগঠিত এনসিপির মধ্যে এখন দা-কুমড়া সম্পর্ক। জামায়াত-এনসিপির মধ্যে দূরত্ব বাড়ায় সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না বিএনপি। রাজনীতির মাঠে গুঞ্জন, বিএনপির সঙ্গেই জোট হতে যাচ্ছে এনসিপির।
আওয়ামী শাসনামলে টানা ১৫ বছর হামলা-মামলায় পিষ্ট ছিল বিএনপি-জামায়াত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মুক্তভাবে তাদের নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে। আগস্টের দিনগুলোয় দল দুটির নেতাদের বয়ানে সেটির শর্তহীন স্বীকারোক্তি রয়েছে। কিন্তু ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নয়া বয়ান হাজির করছেন ক্ষমতার সিঁড়িতে অপেক্ষমাণ দল দুটির নেতারা।
রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, ক্ষমতার সিঁড়ি স্থির নয়, এটি চলন্ত। ভোটের রাজনীতিতে পোক্ত অবস্থানের কারণে মধ্যপন্থি দল বিএনপি সেই চলন্ত সিঁড়ির সামনে। কর্তৃপক্ষের ঘোষণা মেনে তারা সিঁড়ির এক পাশে দাঁড়িয়ে। কয়েক ধাপ পেছনে জামায়াত। কিন্তু বাধা তো অনেক। ক্ষমতার প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার চলন্ত সিঁড়িটিতে আরও কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। তাদের অনেকেই হাসিনা আমলে নির্যাতন-বঞ্চনার শিকার।
পিআর ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলেও সেই সনদে স্বাক্ষর করায় এনসিপির চক্ষুশূল জামায়াত। নতুন করে গণভোটের কথা বলা জামায়াত শেষ পর্যন্ত কি নির্বাচনে যাবে, নাকি গণভোটের জন্য গো ধরবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। তা ছাড়া নির্বাচনে গেলে এককভাবে অংশ নেবে, নাকি ইসলামিক দলগুলোকে নিয়ে জোট করবে, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের জয়জয়কারে জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের অবস্থান কতটা ভালো হবে, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। যদিও আওয়ামী লীগের ভোটে নজর দুই দলেরই।
আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ার পর জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। একদিকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা, অন্যদিকে তাদের বিচারের দাবি তুলছে জামায়াত। বিপরীতমুখী বক্তব্যের পরও আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন সমঝোতার অভিযোগ করছে বিএনপি। যদিও জামায়াত বলছে, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে বিএনপিই। নানা সমীকরণের পরও জামায়াতের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকুÑ এমন প্রশ্ন উঠেছে।
আওয়ামী লীগের পতনের পর সংগত কারণেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি। তিনবার সরকার গঠন করা দলটি ফের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও তাদের আশ্রয়দাতা ভারতবিরোধী কার্ডের বড় স্টেইক বিএনপির। জামায়াতও সেই কার্ডের দাবি করত। কিন্তু এখন দুই দলের ভারতবিরোধিতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। বরং ৫ আগস্টের পর রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ ঘটেছে।
উল্লেখ্য, বিএনপি-জামায়াত দল দুটির গঠনতন্ত্র, কর্মসূচি মানুষের মধ্যে অবস্থানে স্পষ্টত পার্থক্য রয়েছে। জামায়াতের নামের সঙ্গেই ইসলাম শব্দ যুক্ত। সারা বছর তারা ধর্মকে সামনে রেখেই সমুদয় কর্মসূচি পালন করে।
এতে তাদের কোনো রাখঢাক নেই। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান স্বতন্ত্র। ভোটের মাঠে তাদের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী নয়া রাজনীতি বিশেষত আওয়ামী লীগের শূন্যস্থান পূরণের খেলায় কে কতটা জায়গা করে নিতে পারে, তা দেখার বিষয়। যদিও রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ওয়াকওভার দিলে হিসাব হবে একরকম, ডামি প্রার্থী দিলে হবে অন্য রকম। তখনই মিলবে আজকের দ্বান্দ্বিক অবস্থানে থাকা বিএনপি-জামায়াতের অঙ্ক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না আর রাজনীতিতে তো প্রশ্নই ওঠে না। আওয়ামী লীগ বিতাড়িত, সে জায়গা ফাঁকা থাকবে না। জামায়াত যদি রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ হয়, সেটি তো মন্দ নয়। নির্বাচনে জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারা ক্ষমতায় যাবে। বিএনপিকে ভোট দিলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে আর জামায়াত যদি ভোটারদের মন জয় করতে পারে, তারা ক্ষমতায় যাবে তাতে তো অসুবিধা নেই। কিন্তু ভোট হতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। কোনো ছলচাতুরি চলবে না। বিএনপির দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিল জামায়াত, কিন্তু আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। কথার লড়াই চলবে, তবে সবারই মনে রাখতে হবে, যাতে মাত্রা না ছাড়ায়।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রাজনীতিতে কোনো জোটই চিরস্থায়ী নয়। সময় বদলায়, রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল বদলায়। বিএনপির সঙ্গে জোট করেছি, এখন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছি যেমন, ঠিক তেমনি ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য আমাদের অটুট ছিল। দুই দলের নেতাকর্মীরা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। আমাদের অনেক নেতাকে মিথ্যা মামলায় আওয়ামী লীগ ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। বিএনপির অনেক নেতাকে গুম করেছে পতিত ফ্যাসিবাদ। আগামী নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচন করবে তাদের মতো করে, জামায়াত নির্বাচন করবে তাদের মতো। আমরা মনে করি, জামায়াতের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমাদের ভোটও বেড়েছে। আমরা রাজনীতির মাঠে নতুন দল নই। দেশের মানুষ চাইলে এবার ক্ষমতায় যাবে জামায়াত।



-20251025150147.webp)
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন