দীর্ঘ ২৯ বছর পর নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহর অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপ নেওয়ার পর থেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন মামলার আসামিরা। যেকোনো মুহূর্তে তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। মামলার প্রধান আসামি সালমান শাহর সাবেক স্ত্রী সামিরা হক ও তার মা লতিফা হক লুসি দেশে অবস্থান করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
গত ২০ অক্টোবর সালমান শাহর অপমৃত্যু মামলাকে হত্যা মামলায় রূপান্তরের নির্দেশ দেন আদালত। মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া নির্দেশের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন সালমান শাহর মামা আলমগীর কুমকুম। এর পর থেকেই আত্মগোপনে সামিরা ও তার মা। ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরটিও রেখেছেন বন্ধ। আসামিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে এরই মধ্যে ইমিগ্রেশনে তথ্য পাঠিয়েছে পুলিশ।
মামলার দ্বিতীয় আসামি রহস্যঘেরা আজিজ মোহাম্মদ ভাই দীর্ঘ সময় ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পরিবার নিয়ে অনেক বছর ধরে তিনি থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন বলে আলোচনা রয়েছে। থাইল্যান্ডের সৈকতে দেশের মতোই আমোদ-ফুর্তিতে মগ্ন রয়েছেন বলে খবর। চলচ্চিত্র নায়িকাসহ বিভিন্ন নারীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদের সম্পর্ক নিয়ে নানা গল্প রয়েছে। তবে বারবারই তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এই মামলার ৩ নম্বর আসামি হলেন অভিনেতা ডন। সালমানের সঙ্গে ডনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তির পরিবারের। বর্তমানে ডন দেশেই অবস্থান করছেন। সালমানের অপমৃত্যু মামলাকে হত্যা মামলায় রূপান্তরের পর থেকে ডন নিজ জন্মস্থান বগুড়ায় রয়েছেন বলে খবর। মাসখানেক আগে ডন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন বলে সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ডনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। এই মামলার বাকি আসামিরা বিদেশে পালিয়ে আছেন বলে জানা গেছে।
নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহর চলে যাওয়াটা আজও যেন এক অমীমাংসিত অধ্যায়। অনেকের হৃদয়ে আজও প্রশ্নটা কাঁটার মতো বিঁধে আছেÑ এটা কি কেবলই আত্মহত্যা ছিল? চার বছরে সাতাশটি ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দিয়ে যিনি কোটি মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছিলেন, তিনি কি সত্যি নিজেই নিজের জীবন কেড়ে নিতে পারেন? এই ভাবনাটা কেবল ভক্তদেরই নয়, পুরো দেশবাসীকেই স্তব্ধ করে দেয়। অবশেষে এই অভিনেতার অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপ নেওয়ায়, একে একে সামনে আসছে অভিনেতার হত্যায় জড়িত অভিযুক্ত অপরাধীদের নাম। সালমান শাহ হত্যা মামলায় সর্বমোট ১১ জনকে আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকেও আসামি করা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামি নায়কের সাবেক স্ত্রী সামিরা হক। অন্য ১০ আসামি হলেনÑ প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, খলনায়ক ডন, লতিফা হক লুসি, ডেভিড, জাভেদ, ফারুক, মেফিয়ার বিউটি সেন্টারের রুবি, আবদুস সাত্তার, সাজু ও রিজভী আহমেদ ফরহাদ।
এদিকে, সালমান শাহ খুন হয়েছেন বলে ২০১৭ সালে ইউটিউবে প্রকাশ করা এক ভিডিওতে দাবি করেছিলেন রাবেয়া সুলতানা ওরফে রুবি নামের এক নারী। সালমানের সেই সময়কার প্রতিবেশী এবং তার স্ত্রী সামিরার ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিউটিশিয়ান রুবি। সালমানকে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হিসেবে রুবির নাম আসে। আদালতে সালমানের মায়ের করা হত্যার অভিযোগে আসামিদের তালিকায় আট নম্বরে রুবির নাম। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন বলে জানা যায়। তবে সালমান হত্যা মামলায় নতুন মোড় নিলেও রুবির হদিস নেই। নায়কের মা নীলা চৌধুরী লন্ডন থেকে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘রুবি মামলার সাক্ষী হতে চেয়েছিলেন। এর পর থেকে উধাও।’ তিনি শঙ্কা করছেন, রুবিকে হত্যা করা হয়েছে, যাতে মামলার সাক্ষী না হতে পারে।
সালমান হত্যা মামলায় আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির পর চলছে অবস্থান শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া। দ্রুতই অভিযুক্ত আসামিদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক। দু-এক দিনের মধ্যে দেশে থাকা আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মোবাইল ট্র্যাকিংসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
দেশের চলচ্চিত্রে সালমান শাহ এসেছিলেন সম্ভাবনার এক ঝড় হয়ে। নব্বইয়ের দশকে যখন সিনেমার মানে ছিল একই গল্প, একই মুখ; একই সংলাপ, তখন তিনি যেন এক নতুন ঝড়ের আবির্ভাব। তার স্টাইল, কথা বলার ধরন; তার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিÑ সবকিছুতেই ছিল এক ভিন্নতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটিই হয়তো তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এক অদৃশ্য চক্রান্তের জন্ম দিয়েছিল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান, জনপ্রিয় ও সফল এই অভিনেতার সিনেম্যাটিক এই প্রয়াণ তাই আজও আলোচনার বিষয়।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের সেই সকালটা দেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাদময় সকাল। সালমান শাহর অবিশ্বাস্য মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন পুরো দেশ থমকে গিয়েছিল। কেউ ফিসফিস করে বললÑ আত্মহত্যা, কেউ দাবি করল খুন, আবার কেউ একে বলল সাজানো নাটক। কিন্তু সেই আসল সত্যটা আজও অন্ধকারে ঝুলে আছে।
ঊনত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে সেই শোকের সকাল থেকে। সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়েছে, নতুন প্রজন্ম এসেছে, কিন্তু সালমান শাহ আজও বেঁচে আছেন পর্দার ওপারে। তার হাসি, তার মায়াবী চোখ; তার প্রতিটি সংলাপ আজও মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। অবশেষে, এত দীর্ঘ অপেক্ষার পর, সেই রহস্যময় মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনদের বিচারপ্রক্রিয়ার মুখোমুখি করা হচ্ছে। হয়তো এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে দেরিতে হলেও সবচেয়ে প্রত্যাশিত বিচারগুলোর মধ্যে একটি হতে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন