- বিয়ারিং প্যাডের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল নির্মাণকালেই
- সম্ভাব্য নকশাগত ত্রুটির কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটছে: দাবি বিশেষজ্ঞদের
- জীবনের দাম ৫ লাখ টাকা হাস্যকর!
রাজধানীতে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারী নিহতের ঘটনার পর এর নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। ট্রেন চলার সময় কম্পন কমাতে এই বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা হয়। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বরে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। এ সময় প্রায় ১১ ঘণ্টা আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো চলাচল বন্ধ ছিল। তখন থেকেই মেট্রোরেল ব্যবস্থার নকশা এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। এবার একই রকম ঘটনায় প্রাণহানির পর নড়েচড়ে বসেছে কর্তৃপক্ষ। ফের প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা নিয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিয়ারিং প্যাড নিয়ে নির্মাণের সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে এ ব্যাপারে আপত্তিও জানানো হয়েছিল, যা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। কিন্তু তখন অদৃশ্য কারণে কেউ তাতে কর্ণপাত করেনি। শেষ পর্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ বিয়ারিং প্যাডই বসানো হয়। প্রশ্ন উঠেছে, তখন যদি ত্রুটিপূর্ণ বিয়ারিংয়ের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হতো, তাহলে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দেখতে হতো না।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সম্ভাব্য নকশাগত ত্রুটির কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা জানান, মেট্রোরেল লাইনের বাঁকে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে এবং সেখানেই প্যাডটি খসে পড়েছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রোববার দুুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেট এলাকায় মেট্রো লাইনের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
দুর্ঘটনার বিষয়ে ডিএমপির তেজগাঁও থানার ওসি মোবারক হোসেন বলেন, ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনের ফুটপাত দিয়ে আবুল কালাম আজাদ নামে এক পথচারী হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ওপর থেকে বিয়ারিং প্যাড পড়লে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই প্যাড পড়ে একজন মারা যাওয়ার পাশাপাশি ফুটপাতে একটি চায়ের দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর একই লাইনের খামারবাড়ি এলাকায় একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়লে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। সেই ঘটনায় যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, সেই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের এমডি ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আগের কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সবগুলো পিলার ফিজিক্যালি এক্সপার্ট দিয়ে পরিদর্শন করা হয়েছিল।’
এ সময় তার পাশে দাঁড়ানো উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান আঙুল তুলে প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে এটা হলো কীভাবে?’
আগের ঘটনায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি নাÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের এমডি বলেন, ‘তখন বলা হয়েছিল, ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। তাই বিষয়টি সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তাদের (ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে)। তারা তখন বলেছে, তারা সেটা সংশোধন করেছে।’
এ সময় উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা জাপানি ঠিকাদারেরা করেছে। এখানে বলা হচ্ছে, এটা ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডের মধ্যে ঘটেছে। তবে এখন যে কমিটি হচ্ছে, এই কমিটি আগের কমিটির রিপোর্টও দেখবে।’
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘যেখানে ট্রেন বাঁক নেয়, সেখানে চাপ বেশি থাকে। কিন্তু নকশাতেই হয়তো এই অতিরিক্ত চাপের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিয়ারিং ধরে রাখার জন্য রাবারের প্যাডটি ভালোভাবে আটকানো ছিল না। ফলে এটি অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে পারেনি।’ ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে তিনি আরও চাপ সহনশীল ও উন্নত প্রযুক্তির ‘প্যাড বিয়ারিং’ ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বিয়ারিং প্যাডের কাজ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘যখন ট্রেন চলে, তখন এটি কিছুটা সংকুচিত হয় এবং ট্রেন চলে গেলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। যদি প্যাডটি তার কার্যকারিতা হারায় বা পড়ে যায়, তাহলে কাঠামোর মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়।’ তিনি আরও জানান, এই প্যাডগুলো ভূমিকম্পের সময়ও কাঠামোকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, বিয়ারিং প্যাডটি বসানো হয়েছে মেট্রোর নিরাপদ চলাচল ও স্থাপনার স্থায়িত্ব ধরে রাখতে। কিন্তু এই ব্যবস্থা নিচে পড়ে মানুষ মারা গেলে তো বলতে হবে এর নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে। মেট্রোরেলের জন্য সবচেয়ে দামি জাপানি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাহলে তাদের নকশায় কি কোনো ত্রুটি ছিল?
তিনি বলেন, মেট্রোরেলের চলাচলের কারণে কম্পনজনিত ভার তৈরি হয়। এটা তো যেকোনো প্রকৌশলীর জানার কথা। এর জন্য যেখানে নাট-বল্টু থাকে, সেগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু মেট্রোরেলের পিলারের ওপর তো বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়েছে। তা যাতে নিচে না পড়ে যায়, সেই ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল।
জীবনের দাম ৫ লাখ টাকাÑ এটি হাস্যকর উল্লেখ করে ঢাকা কলেজের ছাত্র শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, যে দেশে জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেখানে ৫ লাখ টাকা দিয়ে সহমর্মিতা দেখানো দুঃখজনক।
মেট্রোরেলে চলাচলকারী তন্ময় কুমার নামে এক ব্যক্তি জানান, মেট্রোরেলের মতো একটা বড় প্রকল্পে এমন ঘটনায় মানুষের নিরাপত্তাহীনতার চরম আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এমন ছোট ত্রুটি বড় দুর্ঘটনার ইঙ্গিত বলেও মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মেট্রোরেলে ব্যবহারের আগে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে এসব বিয়ারিং প্যাডের কারিগরি মান পরীক্ষা করা হয়েছিল। বুয়েটের পরীক্ষায় দেখা যায়, একাধিক বিয়ারিং প্যাডের মান যথাযথ নয়। ওই সময় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এক সভায়ও বিষয়টি উঠে আসে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এসেছে, বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষায় উত্তরা-আগারগাঁও অংশের দুটি প্যাকেজের জন্য আমদানি করা বিয়ারিং প্যাডের মান যথাযথ নয় বলে দেখা যায়। এসব বিয়ারিং প্যাড সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই। সে সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, মেট্রোরেল প্রকল্পে নি¤œমানের বিয়ারিং প্যাড সরবরাহের ঘটনাটি ঘটেছিল উত্তরা-আগারগাঁও অংশের প্যাকেজ ৩ ও ৪-এর নির্মাণকাজে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজটি বাস্তবায়ন করছিল ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ইতাল-থাই)। মেট্রোরেলের উত্তর-আগারগাঁও অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার। যখন অভিযোগ ওঠে, ততদিনে পিয়ার ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বিয়ারিং প্যাড বসিয়ে প্রায় আট কিলোমিটার উড়ালপথ বসানো হয়ে গেছে। কিন্তু পরে সেগুলো পরিবর্তন করা হয়নি।
বিয়ারিং প্যাডের কারিগরি মান বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারার বিষয়টি উঠে আসার পর বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, মেট্রোরেলের গুরুত্বপূর্ণ এই উপকরণ মানহীন হলে তা গোটা অবকাঠামোকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, গত বছর যে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, ওই একই স্থানে রোববার ঘটনা ঘটেনি। রোববার ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে, যা ফার্মগেট স্টেশনের ঠিক পশ্চিম পাশে। গত বছর ৪৩০ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। মেট্রোরেলে (মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত) মোট পিলার আছে ৬২০টি। প্রতিটি পিলারে চারটি করে বিয়ারিং প্যাড আছে। সে হিসাবে মেট্রোরেলে মোট বিয়ারিং প্যাড আছে ২ হাজার ৪৮০টি।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেন বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ল, তা তদন্ত করা হবে। কার দায়দায়িত্বে অবহেলা আছে, তা-ও বের করা হবে। নকশায় ত্রুটি থাকার বিষয়টিও নাকচ করছি না। সবকিছুই তদন্ত করে বের করা হবে।’
বিয়ারিং প্যাডের কাজ কী?
বিয়ারিং প্যাডগুলো পথের বাঁকানো অংশে বসানো থাকে, যেখানে ট্রেন যাওয়ার সময় কাঠামোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। এই প্যাডগুলো কেবল ট্রেনের ওজনই বহন করে না, বরং ট্রেন চলার সময় সৃষ্ট কম্পনও শোষণ করে। যখন একটি বাঁকে বিয়ারিং প্যাড অকেজো হয়ে পড়ে, তখন পিলারের ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়। এতে কাঠামোগত ক্ষতি, এমনকি ধসের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এই প্যাডগুলো ভাইব্রেশন, শক এবং ভূমিকম্পের মতো পরিস্থিতি থেকেও সুরক্ষা দেয়। তাই এগুলো ঠিকমতো কাজ না করলে ট্রেন এবং নিচে রাস্তায় থাকা মানুষ মারাত্মক বিপদের মধ্যে পড়ে।
ব্যবস্থাগত যেসব সমস্যা আগে চিহ্নিত হয়েছিল: এর আগেও মেট্রোরেল ব্যবস্থায় বেশ কিছু বড় ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছিল। উড়ালপথের যেসব জায়গায় বেশি চাপ পড়ে, সেখানকার জন্য নকশাটি যথেষ্ট মজবুত ছিল না। বিশেষজ্ঞরা রাবারের বদলে আরও টেকসই ধাতব পদার্থ ব্যবহারের সুপারিশ করেছিলেন।
২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা সনদ ছাড়াই মেট্রো চলছিল, যা ছিল বেআইনি। মেট্রো চালু হওয়ার পর থেকে ডিটিসিএর কাছে কোনো নিরাপত্তা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।
মেট্রোরেল বা যাত্রীদের জন্য কোনো বিমা ছিল না। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
তদন্তের জন্য গঠিত সাত সদস্যের একটি কমিটি চাপ ও নড়াচড়া পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যামেরা বসানোর সুপারিশ করলেও নকশাগত ত্রুটির বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। তবে কর্তৃপক্ষ নকশাগত ত্রুটির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিল, বিভিন্ন কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে।
ডিএমটিসিএল একটি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিরাপত্তা সনদ পাওয়ার চেষ্টা করছিল এবং জীবন বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে বিমা চালুর বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছিল।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন