ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ১৩ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ৪০ জন। এ সময়ে গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ১৫৩ জনের। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৩ মাস অতিক্রম করলেও, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্থাটি। অধিকার গত ৩০ অক্টোবর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের সহযোগী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- মোট ৪০টি। এর মধ্যে নির্যাতনে মৃত্যু ১৪, গুলিতে নিহত ১৯ এবং পিটিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন সাতজন।
অধিকার বলেছে, ২০২৫ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরÑ এই তিন মাসে ১১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশের হাতে, একজন সেনাবাহিনীর হাতে এবং সাতজন যৌথ বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার। নিহতদের মধ্যে তিনজনকে নির্যাতনে, ছয়জনকে গুলিতে এবং দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত বছরের আগস্টের ৯ তারিখের পর ওই মাসে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেনি। সেপ্টেম্বরে ৯ জনের পর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে একজন করে হত্যাকা-ের শিকার হন। এরপর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মারা যান পাঁচজন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন। মার্চ ও এপ্রিল মাসে মারা যান একজন করে। এরপর মে, জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকারের সংখ্যা যথাক্রমে ৪, ৩, ৬, ৩ ও ২।
অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১৩ মাসে গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ১৫৩ জনের। এ ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে গত সেপ্টেম্বরে, ১৮টি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ ঘটনা ছিল ১৭টি। গত তিন মাসে এমন ঘটনার সংখ্যা ৪৫।
অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৩ মাসে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ২৪২টি। এর মধ্যে আহত হয়েছেন ১২৯ জন, নিহত ১, লাঞ্ছিত ৪৩, আক্রমণ ৫, হুমকির শিকার ৩১ এবং মামলার শিকার ৩৩ জন।
অধিকারের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ১ জন নিহত, ৩৪ জন আহত, ১১ জন লাঞ্ছিত, ৯ জন হুমকির শিকার ও ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ৯৭৯টি। এর মধ্যে নিহত ২৮১, আহত ৭ হাজার ৬৯৮ জন। এ ছাড়া চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৪৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৫৩৭ জন আহত হয়েছেন। এই তিন মাসে বিএনপির ৮২টি ও আওয়ামী লীগের একটি অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আটজন নিহত ও ৭৪০ জন আহত এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ১২ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে এ বছরের মার্চে, ৯৪৪টি। ৮৬২টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। গত বছরের আগস্টে (৯-৩১ আগস্ট) সংখ্যাটি ছিল ৫০০। ৭৯৮টি ঘটনা ঘটে এ বছরের এপ্রিলে। গত জুন, জুলাই ও আগস্টে সংখ্যাটি ছিল যথাক্রমে ৪৮৯, ৫৭৯ ও ৬৫৮। গত সেপ্টেম্বরে সংখ্যাটি নেমে দাঁড়ায় ৩০০-তে।
১৩ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হন ২৮১ জন। সবচেয়ে বেশি ব্যক্তি নিহত হন এ বছরের মার্চে ৪৪ জন, এরপর এক মাসে বেশি নিহত হন গত বছরের আগস্টের ২৩ দিনে ৩৩ জন।
গত তিন মাসে ১৮৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭৭ জন নারী এবং ১১১ জন মেয়েশিশু। ওই ৭৭ জন নারীর মধ্যে ১৮ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং দুজন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন। ১১১ জন কন্যাশিশুর মধ্যে ১৩ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট আটজন নারী ও মেয়েশিশু যৌন হয়রানির (উত্ত্যক্তকরণ) শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুজন পুরুষ আহত হয়েছেন এবং তিনজন নারী নিহত হয়েছেন। গত তিন মাসে মোট ১২ জন নারী যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ছয়জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে, পাঁচজন বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার এবং একজন আত্মহত্যা করেছেন।
উল্লিখিত সময়ে সীমান্তে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন ৩৫ জন বাংলাদেশি, আহত হয়েছেন ৩৪ জন এবং পুশ ইন করা হয়েছে ২ হাজার ৩৩৩ জনকে। অবশ্য পুশ ইনের ঘটনাগুলো ঘটেছে চলতি বছরের মে মাস থেকে। এ ছাড়া চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ১০ বাংলাদেশি নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়েছেন। নিহত ১০ জনের মধ্যে সাতজনকে গুলি করে হত্যা এবং তিনজনকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১০ জনকে গুলি করে এবং চারজনকে নির্যাতন করে আহত করা হয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সীমান্ত এলাকার মানবাধিকারকর্মীদের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ ৫৪৪ জনকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।
