বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে নভেম্বর মাস এবার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ, গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক বিভাজন, শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় ঘোষণার তারিখÑ এ তিন ঘটনাই নভেম্বরকে সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তাপের মাসে পরিণত করেছে। সব কিছু মিলিয়ে চলতি নভেম্বর দেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাস হিসেবে দেখা দিতে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, নভেম্বর শুধু একটি মাস নয়Ñ এটি আগামী নির্বাচনের গতিপথ নির্ধারণের পরীক্ষা।
এই বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. সাব্বীর আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি। না হলে এখনকার পোস্ট-আপরাইজিং সময়ে দলগুলো একে অপরের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে।’
গণভোট নিয়ে দ্বিমতেই মূল অস্থিরতা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার)’ বাস্তবায়নসংক্রান্ত সুপারিশ হস্তান্তর করে। সুপারিশে বলা হয়, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ জারি করে গণভোট আয়োজন করতে হবে।
কমিশন আরও প্রস্তাব করে, গণভোটে জনগণ অনুমোদন দিলে পরবর্তী জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে এবং নির্ধারিত ২৭০ দিনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের পথরেখা তৈরি করবে। তা করতে ব্যর্থ হলে তা অটো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এখানেই শুরু হয় রাজনৈতিক মতবিরোধ আর গবেষকদের মতভিন্নতা।
অপরদিকে গণভোট ও নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপি বলছে, নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজন করা হোক, এক দিনে দুটি ব্যালটেই জনগণ সিদ্ধান্ত নিক। জামায়াত চায় নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট, যাতে নির্বাচনের আগে জনগণের রায় জানা যায়। এনসিপি বলছে, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত; কিন্তু নির্বাচনের আগে। মূলত, গণভোটের সময় নিয়ে বিরোধই এখন রাজনৈতিক উত্তাপের কেন্দ্রবিন্দুতে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম গতকাল শুক্রবার নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘গণভোট নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টা নেবেন। তবে জাতীয় নির্বাচন ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই হবেÑ এ বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে, আমরা এটিকে হুমকি হিসেবে দেখছি না। জনগণের কল্যাণে যেটি সবচেয়ে উত্তম, সেটিই করা হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তীব্র। প্রধান উপদেষ্টা শিগগিরই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৭০ দিন ধরে আলোচনা চলেছে, কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। এখন আর বিলম্বের সুযোগ নেই।’ আইন উপদেষ্টার এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্টÑ নভেম্বর মাসেই গণভোটের সময়সূচি বা আদেশ জারি হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘোষণার মাধ্যমে সরকার একদিকে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, অন্যদিকে গণভোটের সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিকভাবে খোলা রেখেছেÑ যা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
১৩ নভেম্বর শেখ হাসিনার রায় নিয়ে উত্তেজনা বাড়ার শঙ্কা
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগামী ১৩ নভেম্বর আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করবে। এই দিনটি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তীব্র আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ, আদালতের রায়ের প্রকৃতি ও সময়কাল রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসতে পারে, যা গণভোট বা নির্বাচনের প্রস্তুতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দিনটি যদি কোনো পক্ষে বা বিপক্ষে বড় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তবে নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ঘিরে আইনি প্রশ্ন
ঐকমত্য কমিশন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমন্বয়ে কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করেছে। রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের মতামত ছিল ভিন্নমত রেখে সনদ বাস্তবায়ন করা হলে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। কমিশনও সেটাই মনে করে। তা ছাড়া নোট অব ডিসেন্ট হলো একটি সিদ্ধান্তে কারো ভিন্নমতের উল্লেখ। এতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঐকমত্য কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছেÑ যদি সংসদ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়, তবে তা জনগণের অনুমোদনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবেÑ এটি নিয়েই তৈরি হয়েছে বড় বিতর্ক। এই বিতর্কই এখন গণভোটের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যা নভেম্বরের রাজনৈতিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও সংসদবিষয়ক গবেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু যুক্ত হওয়ার বিধান নেই। সংসদের অনুমোদন ছাড়া কোনো সাংবিধানিক প্রস্তাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘গিলোটিন প্রসিডিউর সাধারণত বাজেটের অর্থ বিলের ক্ষেত্রে হয়, সংবিধান সংশোধনের মতো বিষয় এতে প্রযোজ্য নয়।’
ঐকমত্য কমিশনের সংবিধান সংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো কিছু মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন আনা। যেমন ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সংবিধান সংশোধনপদ্ধতি কঠিন করা, যাতে কোনো দল ইচ্ছামতো তা পরিবর্তন করতে না পারে। এ জন্য বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার একটি হলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন। এ পদ্ধতিতে সারা দেশে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। নি¤œকক্ষে (সংসদ) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধনী বিল অনুমোদিত হওয়ার পর উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এটি পাস হতে হবে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ হলে একক দলের ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধন কঠিন হবে।
উল্লেখ্য, জুলাই জাতীয় সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অন্তত ৩৬টিতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। ১৭ অক্টোবর যে জুলাই জাতীয় সনদ সই হয়েছে, সেখানে কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা উল্লেখ করে রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত অংশে বলা হয়েছে, ‘অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেই মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’
সামাজিক মাধ্যমে ‘হ্যাঁÑনা’ প্রচারণা
গণভোটের সম্ভাবনা ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক অনলাইনে নতুন মাত্রা পেয়েছে। গত ২৯ অক্টোবর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও এক্সে ছড়িয়ে পড়েছে রঙিন পোস্টারÑ ‘হ্যাঁ’ বনাম ‘না’ প্রচারণা।
বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ‘না’ প্রচারণায় সক্রিয়, অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জামায়াত ও নাগরিক সংগঠনগুলো ‘হ্যাঁ’ প্রচারণায় ব্যস্ত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, অনলাইনে এই মেরুকরণ রাজপথে প্রতিফলিত হতে দেরি হবে না।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, গণভোট নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা ঠেকাতে সামাজিক মাধ্যম মনিটর করা হচ্ছে।
বিএনপির অভিযোগ: ঐকমত্য নয়, একপেশে প্রস্তাব
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব জনগণের ঐকমত্য নয়, বরং একপেশে মতামতের প্রতিফলন।’
তিনি বলেন, ‘‘জুলাই সনদের খসড়ায় বিএনপির ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উল্লেখ করা হয়নি। সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির, অন্তর্বর্তী সরকারের নয়। বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করা রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্তিকর ও প্রশাসনিকভাবে অযৌক্তিক।’’
জামায়াতের অবস্থান: দেরি করলে নির্বাচন সংকটে পড়বে
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘সরকার যদি নভেম্বরে গণভোট না করে, তাহলে জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়বে। জনগণ আগে নিজেদের মতামত জানাতে চায়।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘ঐকমত্য কমিশন গণভোটের নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।’
বিশ্লেষকদের অভিমত: তিন ফ্রন্টেই উত্তাপ বাড়ছে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নভেম্বরের উত্তেজনার পেছনে তিনটি ফ্রন্ট একই সঙ্গে সক্রিয় হচ্ছেÑ রাজনৈতিক ফ্রন্ট: বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিÑ এই তিন শিবিরের মধ্যে অবস্থানগত সংঘাত বাড়ছে। আইনি ফ্রন্ট: ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব সংবিধানগতভাবে বৈধ কি নাÑ এই প্রশ্ন আদালত ও আইনজীবী সমাজে আলোচনার কেন্দ্রে। এবং ১৩ নভেম্বর আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের মধ্যে চলছে উত্তেজনা। এবং জনমত ফ্রন্ট: গণভোটের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণা এখন জনগণের আবেগ ও সামাজিক মাধ্যমের আলোচনায় প্রভাব ফেলছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. সাব্বীর আহমেদ বলেন, ‘নভেম্বরের প্রথমার্ধে যদি গণভোটের আদেশ বা তারিখ ঘোষণা না হয়, তাহলে বিরোধী শিবির রাজপথে নামতে পারে। আবার ১৩ নভেম্বরের আদালতের ঘটনাও সমান্তরাল উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটাতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঠিক মোতায়েন এবং প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সরকারের কাছে একটি স্পষ্ট কাঠামো থাকা উচিত। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না নিলে নির্বাচন ঘিরে জটিলতা দেখা দিতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো কোনো স্পষ্ট মতৈক্যে পৌঁছানো যায়নি। বরং এখানে মতভেদের প্রবণতা বাড়ছে। দ্রুত সমাধান না হলে রাজনৈতিক ভাঙাগড়ার নতুন ধাপ শুরু হতে পারে।’
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকবে। রাজধানী, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটে বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

