নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষ করেছেন দলীয় হাইকমান্ড। এসব বিষয়ে শিগগির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এর পরই একক প্রার্থী মনোনয়নের কথা জানানো হবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিকে দল থেকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন জানিয়ে বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন, যাতে বাড়ছে বিভ্রান্তি। এ ছাড়া অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশীর অভিযোগ, জুলাই বিপ্লবের পর যারা বেশি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছে, তাদের দল বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে সরাসরি তারা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চান না। অনেক প্রার্থীর দাবি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মীমাংসা না করেই অনেককে ফোনকলের মাধ্যমেই মনোনয়ন দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করলে বিএনপি ফের সংকটে পড়তে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, তারেক রহমানের ফোনকল ও সিগন্যালের নামে নিজেদের এমপি প্রার্থী দাবি করেছেন দলের একশ্রেণির নেতারা। শুধু দাবি নয়, তারা বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তবে এদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিলে দল সংকটে পড়বে, যেটা নিয়ে দলীয় অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা গেছে। এসব প্রার্থীর আক্ষেপ, তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, যা বিএনপির জন্য ভালো কোনো বার্তা বয়ে আনে না। এর থেকে দলকে এখন থেকেই উত্তরণ করতে হবে, অন্যথায় এমপি প্রার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলকে সংকটে ফেলতে পারেন।
একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বলছেন, তারেক রহমানের ফোনকলে বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিশ্চিত করেছেন বলে অনেকেই ঢোল পেটাচ্ছেন। পাশাপাশি তারা অন্যদের অবমূল্যায়ন করছেন, যে কারণে বিভিন্ন জেলায় দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, সেই সঙ্গে এক প্ল্যাটফর্মে সবাইকে আনতে বিএনপি কি ব্যর্থ হচ্ছেÑ এমন প্রশ্ন অনেকের।
বাগেরহাট-৩ আসনের এক এমপি পদপ্রার্থী নাম প্রকাশে অপারগতা জানিয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম। এ আসন থেকে যিনি এমপি হতে চাইছেন, তিনি দলের দুর্দিনে গত ১৭ বছর মাঠে ছিলেন না। তার অনেক টাকা, তিনি নিজেকে এমপি হিসেবে প্রচার করছেন। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে এমপি প্রার্থীদের বৈঠকের পর আমার আসনের সাবেক এমপি আমরা যারা মনোনয়োন চাইাছি, তাদের সবাইকে শত্রু ভাবছেন। মনে হচ্ছে, আমরা যেন বিএনপি করি না, সবাই বিরোধী কোনো দলের লোক।’
যশোর-৫ আসনের আরেক এমপি পদপ্রার্থী জানান, ‘আমাদের আসনে যিনি জুলাই-আগস্টের পর অপরাধে যুক্ত হয়েছিলেন, তাকে দল মনোনয়ন দেবে বলে শোনা যাচ্ছে। তিনি নাকি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ফোনকল এবং তার সিগন্যালও পেয়েছেনÑ এমনটা প্রচার করছেন। তিনি নিজেকে এমপি দাবি করে বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এসব কারণে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। এ ছাড়া আরও যারা প্রার্থী হতে চাইছেন, তাদের কর্মীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। দলের উচিত এসব সমস্যা সমাধান করে এমপি ঘোষণা দেওয়া এবং সংগঠনিক শক্তি বাড়ানো, যাতে সবাই মিলে ধানের শীষে ভোট চাইতে পারেন সেই পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া।’
ত্যাগী নেতাকর্মীদের দাবি, জুলাই বিপ্লবের পর যারা সবচেয়ে বেশি অপরাধে জড়িয়েছেন, তাদের দল মনোনয়নের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের আগে তারা সাংগঠনিক কার্যক্রমেও ছিলেন না। কিন্তু তাদের লবিং ও আর্থিক জোরের কারণে রাজপথে থাকা বিএনপির এমপি পদপ্রার্থীরা পেরে উঠছেন না।
যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহসভাপতি মোরতাজুল করিম বাদরু কুমিল্লা-৮ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি তাকে মনোনয়ন দিয়েছিল, কিন্তু এবার তিনি ডাক পাননি। মোরতাজুল করিম বাদরু বলেন, ‘বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলাম। যুবদলকে নেতৃত্ব দিয়েছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিটি নির্দেশ মেনে রাজনীতি করেছি। কিন্তু এখন কর্মীর মূল্যায়নও পাচ্ছি না।’ তাকে কেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মতবিনিময়ে ডাকা হয়নি, তা তিনি বুঝতে পারছেন না বলেও জানান। নেত্রকোনা-৩ আসনের একাধিকবারের এমপি মরহুম নূরুল আমিন তালুকদারের ছেলে রায়হান আমিন রনি ওই আসনের একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাকেও ডাকা হয়নি। সুনামগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুল মোতালিব খান। তিনি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনি এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন। এই আসন থেকে পাঁচ-ছয়জন নেতাকে ডাকা হলেও তিনি ডাক পাননি। আব্দুল মোতালিব খান বলেন, ‘অজানা কারণে আমাকে ডাকা হয়নি। দুর্দিনে দলের পাশে ছিলাম। এখন অবহেলিত হচ্ছি। এতে নির্বাচনি এলাকায় কর্মী-সমর্থকেরা হতাশ হয়েছেন।’ এ ছাড়া নওগাঁর আনোয়ার হোসেন বুলু, খুলনার শরীফ শাহ কামাল তাজসহ অসংখ্য প্রার্থীকে মতবিনিময় সভায় ডাকা হয়নি। তাদের অভিযোগ, তাদের চেয়ে কম জনপ্রিয় ও অযোগ্য প্রার্থীরাও গুলশান কার্যালয়ে ডাক পেয়েছেন।
জানা গেছে, সারা দেশে পাঁচ শতাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে সীমিতসংখ্যক গুলশান কার্যালয়ে ডাক পেয়েছেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মনোনয়নপ্রত্যাশী ডাক না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের সমর্থকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। তবে ক্ষোভ প্রকাশকারী মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং তাদের সমর্থকেরা সাংগঠনিক শাস্তির ভয়ে মিডিয়ার সামনে নাম প্রকাশ করছেন না।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের প্রতি ঐক্যবদ্ধ থেকে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। যারা মনোনয়ন পাবেন না, তাদেরও দল ভবিষ্যতে মূল্যায়ন করবে বলে আশ্বস্ত করেছেন তিনি। তবে যারা নিজেদের এমপি পদপ্রার্থী হয়েছেন বলে দাবি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ত্যাগী নেতাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘তারেক রহমানের ফোনকল ও সিগন্যালের নামে নিজেকে এমপি দাবি করে একশ্রেণির অসুধা নেতা অপকর্ম ঢাকতে চাইছেন, দল এদের ক্ষেত্রে সজাগ রয়েছে। দল নিয়ে বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার মেনে নেওয়া হবে না। এ ছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা, বৈষম্যের শিকার অন্য প্রার্থী ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা এসব কিছু দলের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, যাতে আগামী নির্বাচনের আগে গ্রুপিং ও দ্বন্দ্বের কারণে সংকটে পড়তে না হয়, সে ক্ষেত্রে বিএনপি সাংসঠনিকভাবে কাজ করছে। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যোগ্যরা এগিয়ে থাকবেন।’
জানতে চাইলে বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা বলেন, ‘কিছু আসন আছে, যেখানে অনেক প্রার্থী, যারা এগিয়ে তাদের সঙ্গে টেলিফোনে তারেক রহমান কথা বলেছেন। এক কথায় বলা যায়, বিচার-বিশ্লেষণ করে এবং সাংগঠনিকভাবে যোগ্যদের দল মূল্যায়ন করবে।’

