বাংলাদেশের অর্থনীতি আগাগোড়া বদলে ফেলা জাদুর কাঠির নাম তৈরি পোশাকশিল্প। কিন্তু বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও জীবিকার ওপর গুরুতর ঝুঁঁকি তৈরি করছে। শুধু পোশাকশিল্পের শ্রমজীবীরাই যে এমন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তা নয়, কৃষি, নির্মাণ এবং বাইরে কাজ করা শ্রমিকরাও এই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে জীবনযাপন করছেন। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট তীব্র তাপে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পরিমাণও রেকর্ড ছুঁয়েছে।
‘হিট অ্যান্ড গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স রাইটস ফ্যাশনিং এ জাস্ট ট্রানজিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে শ্রমজীবীদের এমন ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই পদক্ষেপ নিতে ফ্যাশন ব্র্যান্ড, সরবরাহকারী এবং সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ক্লিন ক্লোথস ক্যাম্পেইন (সিসিসি)।
জলবায়ুর এমন পরিস্থিতিতে এখনই নীতি পরিবর্তন আবশ্যক বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। আগামী মাসে ব্রাজিলের বেলেমে শহরে অনুষ্ঠিত হবে কপ-৩০ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপামাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখতে না পারলে বিশ ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করলেও ভিন্নমুখী অবস্থান নিয়েছেন এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও দাতব্যকর্মী বিল গেটস। তার মতে, এখন সবচেয়ে জরুরি হলো ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও প্রতিরোধযোগ্য রোগের মোকাবিলা করা। গেটসের এই বক্তব্য এমন এক সময় এলো, যখন আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জলবায়ুবিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন কপ-৩০।
অনেক সমালোচক গেটসের এই অবস্থানকে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি বলেছেন। মার্কিন বিজ্ঞানী মাইকেল ম্যান মন্তব্য করেছেন, ‘বিল গেটস বিষয়টি উল্টোভাবে দেখছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু সংকটই এখন সবচেয়ে বড় হুমকি।’
এদিকে শ্রমজীবীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে ‘হিট অ্যান্ড গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স রাইটস ফ্যাশনিং এ জাস্ট ট্রানজিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় ঝুঁঁকিতে পড়েছে বিশ্বের ৭ কোটি ২০ লাখ শ্রমিক। যার বেশির ভাগই নারী, অভিবাসী ও গৃহভিত্তিক কর্মী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তাপমাত্রা বাড়ার প্রভাবে বিশেষভাবে ঝুঁঁকিপূর্ণ পোশাকশিল্প; কারণ সেখানে আগে থেকেই গরমের প্রভাব তীব্র। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব দেশ পোশাক রপ্তানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এবং একই সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে, সেগুলোর পরিস্থিতি নাজুক। ক্রিটিকাল ৯ নামে চিহ্নিত এমন দেশগুলোর মধ্যে ৬টি (ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ব্রাজিল) বিশ্বের প্রধান পোশাক উৎপাদনকারী। তবে সমস্যাটি শুধু এসব দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, উগান্ডা ও সার্বিয়ার মতো দেশেও শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্র বা বাড়িতে উচ্চ তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাব ভোগ করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী দিন দিন আরও উষ্ণ হচ্ছে। শরৎকালেও কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ছাড়াচ্ছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে হিট স্ট্রোক, কিডনি, হৃদরোগ, ফুসফুস ও ক্যানসারের মতো বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে প্রচ- গরমের কারণে পেশাগত দুর্ঘটনায় প্রায় ১৮,৯৭০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সর্বশেষ ল্যানসেট কাউন্টডাউন প্রতিবেদন অনুযায়ী, নব্বইয়ের দশকের তুলনায় এই মৃত্যুর হার ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বছরে আনুমানিক ৫ লাখ ৪৬ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তাপজনিত মৃত্যু ছাড়াও প্রতিবেদনে অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছর দাবানলের ধোঁয়ার কারণে রেকর্ড ১ লাখ ৫৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রেকর্ড করা ৮৪ শতাংশ প্রাণঘাতী তাপপ্রবাহের দিনের জন্যই জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। তীব্র তাপের কারণে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পরিমাণও রেকর্ড ছুঁয়েছে, যা প্রায় ৬৩ হাজার ৯০০ কোটি ঘণ্টায় পৌঁছেছে। এই সংখ্যা নব্বইয়ের দশকের গড় থেকে প্রায় ৯৮ শতাংশ বেশি। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে আনুমানিক ১.০৯ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে।
অতিরিক্ত গরমে বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিট বা ৬০ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যান। যার অর্থবছরে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। জনস্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ায় ক্রমেই বাড়ছে সমুদ্রের উষ্ণতা, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী করছে। প্রতিনিয়ত বন-জঙ্গল উজার করে নগরায়ণ, শিল্প-কারখানা, অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারসহ মানব সৃষ্ট নানা কারণে বায়ুদূষণের কবলে বিশ্ব। যার ফলে বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। খরা, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও মেঘ ভাঙা বর্ষণের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আবার অতিরিক্ত গরম ও এর প্রভাবে নানা রোগে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে।

