ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বৃহৎ জোট গঠনের চেষ্টায় রয়েছে বিএনপি। আসনভিত্তিক দলীয় একক প্রার্থীর পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল সমমনা দল-জোটসহ অন্যান্য উদার গণতান্ত্রিক, বাম, ইসলামি ও আলেমদের সমন্বয়ে বহত্তর জোট গঠনে তৎপর রয়েছে দলটি। এ নিয়ে এনসিপিসহ জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এরই মধ্যে আলোচনা করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
এদিকে আসন্ন নির্বাচন ঘিরে রেখে নতুন দল হিসেবে সবচেয়ে আলোচনায় রয়েছে এনসিপি। তাদের জন্য আলোচনার পথ এবং সর্বোচ্চ সুযোগ দিতে প্রস্তুত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। যদিও এনসিপি কোন জোটে যাবে এখন পর্যন্ত সে ঘোষণা দেয়নি। তবে সম্ভাব্য আসন সমঝোতা ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার বিষয়ে বিএনপি-জামায়াত উভয় দলের সঙ্গেই অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা করেছে। এনসিপি নেতাদের ভাষ্য, দলীয় প্রতীক এবং জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়টি সুরাহার পরই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি কার্যক্রমে প্রবেশ করবেন। সর্বশেষ এনসিপির দলীয় প্রতীক হিসেবে চাওয়া ‘শাপলা’র পরিবর্তে ‘শাপলা কলি’কে প্রতীক তালিকায় যুক্ত করেছে ইসি। তবে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলাই চাইছে এনসিপি। যদিও শিগগিরই চলমান ইস্যুগুলো সুরাহা হয়ে যেতে পারে বলে দলটির অনেকের ধারণা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে যারা জোট করতে যাচ্ছে, সব দলই ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সেই স্থান থেকে জোটের ফলাফল ইতিবাচক নির্ধারণের বড় উপাদান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের কিছু নির্বাচনি এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের ভোটের ব্যবধান কম হতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে ছোট দলের ভোটই ভারসাম্য বদলে দিতে পারে। সেই স্থান থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে দলগুলোকে। সব মিলিয়ে আসন্ন ভোটে জোটের সমীকরণে ছোট দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত কে কাকে ভরসা করে কোন দলের সঙ্গে সমোঝতা করছেÑ সেটিই এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিএনপি এরই মধ্যে জানিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক মিত্রসহ উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটি জোট করবে। বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এই দলের নেতৃত্বাধীন জোট হলে সেখানে মিত্র ছাড়া আরও অনেক দল থাকবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির বিরাট চ্যালেঞ্জও রয়েছে। জোটের শরিকদের আসন ছাড় দিলেই হবে না, দলের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী যেন শরিকদের আসনে প্রার্থী না হয় তা-ও দেখতে হবে। তবে শরিকদেরও এলাকায় জনপ্রিয়তা যাচাই-বাছাই করে আসন ছাড় দেওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিত্র অনেক দলে জাতীয় নেতা আছেন, কিন্তু তার নিজ এলাকায় তিনি জনপ্রিয় নন। তাদের অন্যভাবেও মূল্যায়ন করার সুযোগ আছে বিএনপির। সেটা সংসদের উচ্চকক্ষও হতে পারে। তা ছাড়া কেবিনেটে নেওয়ার সুযোগও থাকছে।’
এদিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা শুরু করেছে এনসিপি। দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই পছন্দের আসনের ভোটারদের কাছে পরিচিত হওয়ার চেষ্টাও করছেন। তারা জনসংযোগ করছেন, বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। এমন নেতার সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।
বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক জোটের বিষয়ে এনসিপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে এনসিপির আলোচনা চলমান প্রক্রিয়ার অংশ বলতে পারেন। আসন সমঝোতা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।’ বিএনপির পক্ষ থেকে এনসিপিকে ১০ থেকে ১২টি আসনে ছাড় দিতে আগ্রহী বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ঢাকার কমপক্ষে চারটি আসনে বিএনপির সঙ্গে এনসিপির সমঝোতা বিষয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো মতামত জানানো হয়নি।’
এনসিপির সঙ্গে বিএনপির জোট বা সমঝোতা হচ্ছে কি না এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নিয়ে জোট গঠন করবে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে নিয়ে গঠন করা হবে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট। দেশজুড়ে আসনভিত্তিক যোগ্য প্রার্থীদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এক আসনে একাধিক প্রার্থী বাছাই করে রাখলেও ঐক্যের বিষয়টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। আমরা একটিই মেসেজ দিতে চাই, যাতে আমাদের দলের ভেতরে ঐক্য থাকে, জাতির ভেতরে ঐক্য থাকে। জাতির মধ্যে ঐক্যটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। কেউ যাতে বিভেদের পথে না যায়, এই মেসেজটা দিতে চাই।’ তিনি বলেন, এনসিপির সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে আমাদের। তবে জোটবদ্ধ হব কি হব না; তারা হবে কি হবে না, সেটা রাজনীতির মাঠে আগে থেকেই বলা সম্ভব নয়। আমরা আলাপ-আলোচনার মধ্যে আছি। তবে জোটে আসার বিষয়ে তাদের সঙ্গে সরাসরি কোনো আলোচনা হয়নি।’
এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও এনসিপির নেতাদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সরাসরি জোট হওয়ার সম্ভাবনা এখনো নেই। তবে আসন সমঝোতা হতে পারে।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘জোটের বিষয়ে এখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে এটি নির্ভর করছে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর। প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলোর জুলাই সনদে থাকা মৌলিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এমনটি হলেই আমাদের জোটের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। রাজনৈতিক কর্মকা-ের অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এনসিপি তার দলীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখেই জোটের বিষয়ে ভাববে। তবে শুধু আসনের জন্য এনসিপি জোট করবে না।’
এদিকে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য এরই মধ্যে মাঠে পুরোদমে কাজ শুরু করেছে বিএনপি। সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছে দলটি। জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল এমন সমমনা দল ও জোটসহ অন্যান্য উদার গণতান্ত্রিক, বাম, ইসলামি ও আলেমদের সমন্বয়ে জোট গঠন করা হবে। এ নিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। মিত্র দল ও জোটের মধ্যে যথাক্রমেÑ গণতন্ত্র মঞ্চ (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ১২-দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, চারদলীয় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণফোরাম, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) ও লেবার পার্টি বিএনপির বৃহৎ জোটে থাকছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া এনসিপি, গণঅধিকার পার্টিসহ আরও বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে দলটির। অন্যদিকে দেশের আলেমসমাজ ও তাদের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে পাশে চায় বিএনপি। এ জন্য দলটির নেতারা এরই মধ্যে হাটহাজারী মাদরাসা, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, ছারছীনা পীর, আলিয়া মাদরাসা ধারার যেসব মুরব্বি ও আলেম আছেন, তাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন।
একই সঙ্গে তরুণদের দল এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদসহ আরও কয়েকটি দলেরও জোট করার জোর গুঞ্জন রয়েছে। একটি সূত্র বলছে, এই জোট হলে তারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে এলায়েন্স করতে পারে। অথবা পৃথক জোটে থেকেই বিএনপির সঙ্গে ‘আসন সমঝোতা’ হতে পারে। গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা বলছেন, জোট গঠনের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্র। দেখা যাক সেটি কীভাবে গঠিত হয়। তবে আমরা বিএনপির সঙ্গে শুরু থেকেই আছি। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা চাইব বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে অন্য এক আলাপ-আলোচনা চলছে। সবার সঙ্গেই আমরা কথাবার্তা বলব।’ ১২-দলীয় জোটের প্রধান জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম। আগামী নির্বাচনেও একসঙ্গে অংশগ্রহণ করব।’ গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে যে নির্বাচনি জোট হতে যাচ্ছে, তাতে আমরা আছি। এরই মধ্যে আমরা সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকাও জমা দিয়েছি তাদের কাছে।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোট ছিল। ভবিষ্যতেও যেকোনো মেরুকরণে বিএনপির সঙ্গে থাকব।’ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান, ‘আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যে জোট করতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে দল রয়েছে।’
এদিকে, বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নভেম্বর মাসে দেশে ফিরবেন। তার আগেই জোট নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া অনেকটাই এগিয়ে রাখতে চান দায়িত্বশীল নেতারা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফিরলেই এসব দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর তপশিল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জোট গঠনের বিষয়ে ঘোষণা করা হবে।
অতীতে বিএনপির আসন ছাড়: ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ৩০০টি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সে সময় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ১৯টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। এর মধ্যে গণফোরাম পেয়েছিল ৭টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ৪টি, নাগরিক ঐক্য ৪টি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৪টি আসন।

