জুলাই সনদ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এক দল সংস্কারকে ভেস্তে দিচ্ছে, আরেক দল নির্বাচনকে পেছানোর চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন নাহিদ। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কার, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেশে রাজনৈতিক যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সমানভাবে দায়ী।
গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নাহিদ। সংবাদ সম্মেলনে কোনো লিখিত বক্তব্য ছিল না। সরাসরি প্রশ্নোত্তর পর্ব দিয়েই শুরু হয় সংবাদ সম্মেলন।
বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্ব: নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের শুরু থেকেই মৌলিক বিষয়গুলোয় নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বিরোধিতা করার চেষ্টা করেছে। ফলে সংস্কারের পক্ষে তারা কতটুকু আছে, এ বিষয়ে জনগণের ভেতর প্রশ্ন আছে, আমাদের কাছেও প্রশ্ন আছে। অন্যদিকে জামায়াতের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, নির্বাচন পেছানোর কোনো দুরভিসন্ধি তাদের আছে কি না। ফলে এক দল সংস্কারকে ভেস্তে দিচ্ছে, আরেক দল নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছে।’
গণভোটের সময় নিয়ে দ্বন্দ্ব অপ্রয়োজনীয়: গণভোট আগে হবে, না নির্বাচনের দিন হবেÑ এ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত আবার একটা দ্বন্দ্বে চলে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেন নাহিদ ইসলাম। এ দ্বন্দ্ব অযথা ও অপ্রয়োজনীয় বলে জানান তিনি। উচ্চকক্ষে পিআর, দুই কক্ষে পিআরের দাবি এনে এ ইস্যুকে ঘুরিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, সনদে কী কী সংস্কার হবে, কী কী প্রস্তাব থাকবে এবং সেটার আইনি ভিত্তিটা কীভাবে হবে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আদেশ জারি করবেন কি নাÑ এগুলো প্রধান ইস্যু ও প্রধান তর্কের জায়গা। এ জায়গাগুলোয় একমত হলে গণভোট আমরা নির্বাচনের দিনও করতে পারি, আগেও করতে পারি। সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি।
জুলাই সনদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জারি করতে হবে: এনসিপি ফেব্রুয়ারিতে যথাসময়ে নির্বাচন এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন চায় বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, চলতি মাসের মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে আদেশ জারি হয়ে যাওয়া উচিত। মৌলিক সংস্কারে যে জায়গাগুলোয় ঐকমত্য হয়েছে, আমরা মনে করি, সেসব বিষয়ে গণভোটে যাওয়া উচিত। গণভোট নির্বাচনের দিন হতে পারে, আগেও হতে পারে। এটা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।
জুলাই সনদ অধ্যাপক ড. ইউনূসকে জারি করতে হবে বলে মন্তব্য করেন নাহিদ। তিনি বলেন, জুলাই সনদ যদি তথাকথিত রাষ্ট্রপতি কার্যালয় থেকে থেকে জারি হয়, তাহলে এই সনদের কোনো আইনি ও রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি হবে না।
নির্বাচন ভন্ডুলের চেষ্টায় আওয়ামী লীগ :
বর্তমানে রাজনীতির মাঠে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপির সরব ‘মতানৈক্য’ থাকলেও জাতীয় নির্বাচন ভন্ডুলের ‘আওয়ামী লীগের তৎপরতাই’ মুখ্য বলে মনে করেন নাহিদ। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন দলে ভিড়ে নির্বাচন ভ-ুলের ষড়যন্ত্র করবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন দল তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে জায়গা দিচ্ছে। সে জন্য আমরা দলগুলোকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানাই।
জুলাই সনদে বঙ্গবন্ধুর ছবির বিষয়ে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামিয়েছেন। শেখ মুজিবকে ফ্যাসিবাদের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমরা তাকে জাতির পিতা বা ফাউন্ডার মনে করি না। তবে মুক্তিযুদ্ধে তার কৃতিত্ব স্বীকার করি, ইতিহাসে সেই জায়গা তার থাকবে। সংবিধানকে একটা ব্যক্তির সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছিল, তার একটা উদাহরণ হচ্ছে, শেখ মুজিবের ছবিকে বাধ্য করে দেওয়া। সংবিধানকে দলীয়করণ করা হয়েছে। এ ধরনের সব বিধান সংবিধান থেকে অপসারণের দাবি জানাব।
গণঅভ্যুত্থানে ভারতের স্বীকৃতি চান নাহিদ:
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পর থেকে তিনি সেখানেই আছেন। অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। বাণিজ্য সম্পর্কেও চিড় ধরেছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে এক প্রশ্নে অভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতা নাহিদ বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছে। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে, জুলুম করে ক্ষমতায় টিকে ছিল। এর পেছনে ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল। ভারত যদি বাংলাদেশের সাথে ভালো সম্পর্ক চায়, তাহলে ভারতকে আওয়ামী লীগের চোখে বাংলাদেশকে দেখার নীতি থেকে সরে আসতে হবে। সম্পর্ক তৈরি করতে হবে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের যে চেষ্টা ভারত সব সময় করে আসছে, সেই জায়গা থেকে ভারতকে ফিরে আসতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। যৌথ নদীর পানির হিস্যা ও সীমান্ত হত্যাসহ যে সংকটগুলো রয়েছে, সেগুলো সুরাহা করতে হবে। সবার আগে যেটা দরকার তা হচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং গণহত্যাকারী কাউকে সেই দেশে আশ্রয় না দেওয়া।
ভারত শেখ হাসিনাকে সেই দেশে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে গণহত্যাকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে মন্তব্য করে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, যত দিন জুলাই গণঅভ্যুত্থান প্রশ্নে ভারত নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট না করছে, সম্পর্ক স্থাপনের জন্য হাত বাড়িয়ে না দিচ্ছে, তত দিন ভারতের সাথে সম্পর্কের শীতলতা থাকবে।
এনসিপি নির্বাচনে যাচ্ছে:
নাহিদ ইসলাম জানান, তার দল আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। কোন আসন থেকে নির্বাচন করতে চান, জানতে চাইলে নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, আমি যেহেতু ঢাকার সন্তান, আমাকে তো ঢাকা থেকেই হয়তো করতে হবে। আর আমরা এখন পর্যন্ত ৩০০ আসন ধরেই এগোচ্ছি। আমরা হয়তো এই মাসেই আমাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করব। তখনই আসলে দেখা যাবে যে আমাদের কে কোথায় থেকে দাঁড়াচ্ছেন।
এনসিপি কোনো জোটে যাচ্ছে কি না এ প্রশ্নে নাহিদ বলেন, যদি সংস্কারের পক্ষে কেউ না থাকে, তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদের জোটে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মৌলিক দাবিগুলোর সঙ্গে যারা কাছাকাছি আছে, এ রকম দলের সঙ্গে আমাদের যদি ঐক্যবদ্ধ হতে হয় বা কোনো ধরনের সমঝোতায় যেতে হয়, তাহলে সেটা আমরা বিবেচনায় রাখব। এনসিপির দলীয় প্রতীক নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সে প্রসঙ্গে নাহিদ বলেন, আমাদেরকে নির্বাচনি কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতেই বা বাধাগ্রস্ত করতেই নির্বাচন কমিশন এ কাজ করেছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন