ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে দূরত্ব আর বিভক্তি ক্রমেই বাড়ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে স্পষ্ট এক রাজনৈতিক টানাপোড়েনে পড়েছে বিএনপি। দলটি গত কয়েক দিনে কমিশনের কিছু সুপারিশের কড়া সমালোচনা করলেও প্রত্যাখ্যান করার মতো অবস্থান নিতে পারছে না। বিশেষ করে জামায়াত এবং এনসিপি যখন একই সুরে কথা বলছে। তাদের সঙ্গে মিলেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
আরও অনেক ছোট দল ওই শিবিরে যুক্ত হচ্ছে। বিএনপিকে কোণঠাসা করার একটা প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে রাজনীতির মাঠে। সর্বশেষ, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপি-বিরোধী শিবির শক্তি সঞ্চয় করছে। বিএনপি ওই পদ্ধতির নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর সঙ্গে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে আরও অনেক ইস্যু যুক্ত হচ্ছে, যা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ বাড়াচ্ছে। তবে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হওয়া নিয়ে এখনো শঙ্কা না থাকলেও কিছুটা উদ্বিগ্ন বিএনপির নেতৃত্ব। কারণ জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন ও জামায়াত-এনসিপির ভূমিকা দলটির নেতাদের ভাবাচ্ছেÑ বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে।
গত বৃহস্পতিবার থেকে নির্বাচনের আগে গণভোটের বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। কমেন্টে মতামতও পড়ছে বেশ। তবে বিএনপির অ্যাক্টিভিস্টরা ‘না’-এর পক্ষে কাজ করছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে জামায়াতের অ্যাক্টিভিস্টরা ‘হাঁ’-এর পক্ষে পোস্ট দিচ্ছেন। তবে নির্বাচনের আগে গণভোটের বিষয়ে ‘না’-এর পক্ষেই বেশি মতামত দেখা যাচ্ছে।
যদিও একাধিক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছেন না তারা। তবে কিছুটা উদ্বিগ্ন। কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল অযাচিতভাবে শঙ্কা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তবে বাংলাদেশের মানুষ সেসব দুরভিসন্ধি কখনোই সমর্থন করবে না। যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। বিএনপির আশা, সরকার তাদের কথা রাখবে। বিএনপি নির্বাচন চায় বলেই ডিসেম্বরের অনড় অবস্থান থেকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য রাজি হয়েছে।
বিএনপির মতো ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছে না জামায়াতও। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘যারা সংস্কার বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছেন অথবা সংস্কার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে, কোনো কারণে যদি নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদেরকে এর দায়িত্ব নিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’ জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চায় জামায়াত। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যদি কোনো শঙ্কা তৈরি হয় বা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্তর্বর্তী সরকারকেও সেই দায় নিতে হবেÑ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এ জামায়াত নেতা। আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘বিএনপি এত দিন ধরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে থেকে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পর এখন বলছে, আমরা এটা মানি না। বিএনপি বর্তমানে অন্যায়ভাবে এই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।’
এটা সত্য যে, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিএনপি একটা চাপে পড়েছে। তারা সংস্কারবিরোধী এই পরিচিতি হোক, সেটাও তারা চাচ্ছে না। আবার সংস্কারে এমন কিছু প্রস্তাব আছে, যেটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যও নয়। অর্থাৎ তারা না পারছে গিলতে, না পারছে উগরাতে। এ ছাড়া সংস্কার নিয়ে যে পোলারাইজেশন হয়ে গেছে, তাতে বিএনপি অনেকটা একা হয়ে গেছে বলেই প্রচার বিরোধী শিবিরে। ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, তাতে পরিমার্জন হতে পারে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’- ‘না’ কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, সেটা নিয়েও জটিলতা আছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হওয়ার পরও সর্বোচ্চ ধৈর্য দেখাতে চায় বিএনপি। কোনো ধরনের শক্তি প্রদর্শন বা রাজপথের কর্মসূচি দিয়ে দেশে আপাতত বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করতে চায় না দলটি।
বিএনপি আশা করছে, প্রধান উপদেষ্টা বাস্তবতার নিরিখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। বিএনপি মনে করে, সুপারিশ করলেই সেটা সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সুতরাং জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই গণভোট মানা হবে না। কারণ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এখনো দিচ্ছে। সেই সহযোগিতা কত দিন ধরে রাখতে পারবে তা নিয়েও সংশয় দলটির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে।
অন্যদিকে জামায়াত নিজেদের স্বার্থে প্রশাসনে দলীয়করণ করলেও বিএনপি সে পথে হাঁটেনি। দ্রুততম সময়ে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সরকার গঠনের কথা বলে আসছে বিএনপি। যে কারণে বিএনপি সব সময় শান্তি ও চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, দিচ্ছে। কিন্তু কোনো অশুভ পক্ষ যদি দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায়, নির্বাচন বানচাল করতে চায়, তাহলে বিএনপি বসে থাকবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের এক নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য হবে দলটি। তাদের আশা, সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে বিএনপিকে কঠোর হতে হয়।
এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত, সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করতে চান নেতারা। তাদের মূল লক্ষ্য যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। এ জন্য তারা যত ছাড় দেওয়ার তা দিয়েছেন। গণভোটসহ আরও যেসব ইস্যু আছে, সেখানেও তারা নমনীয় থাকতে চান। তাদের কথাগুলো তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে পৌঁছে দেবেন। তবে তা আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নয়। মিডিয়ার মাধ্যমে, বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে, প্রয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তারা অনৈক্যের বিষয়গুলো জানাবেন। কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনের আগে দলটি গণভোট মেনে নেবে না। গণভোট হলে নির্বাচনের দিনই হতে হবে। আর যদি কোনো কারণে নির্বাচনের আগে গণভোটের সম্ভাবনা তৈরি হয়, তাহলে বিএনপি বসে থাকবে না। হয়তো তখন আর ধৈর্য ধারণ করা হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা দেশটা বাঁচাতে চাই। নির্বাচনটা হোক, নির্বাচনে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, এটাই বিএনপির চাওয়া।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির এই সংযমী অবস্থান কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। যদি সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করে সংস্কার বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়, তাহলে দলটি হয়তো সরকারকে চাপে রাখার মতো পদক্ষেপ নিতে পারে।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন