- একমাত্র ভরসা একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট; লিটারপ্রতি ৭০ পয়সায় কিনতে হয় পানি
- বর্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করেন; শুষ্ক মৌসুমে তীব্র সংকট
- বনদস্যুরা নৌকা লুট ও জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে
- খোলা আকাশের নিচে থেকেও যেন বন্দিজীবন বাসিন্দাদের
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে মোংলার শ্যালা নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি দ্বীপÑ জয়মনির ঠোটা। স্থলপথে এখানে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চারদিকে শুধু নদী আর পানি। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যÑ পানি ঘেরা এ দ্বীপে নেই এক ফোঁটা বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। এমনকি দৈনন্দিন কাজের জন্যও পানির তীব্র সংকট।
স্থানীয়দের একমাত্র ভরসা ব্র্যাকের একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, যেখান থেকে লিটারপ্রতি ৭০ পয়সা দিয়ে পানি কিনতে হয়। বর্ষা মৌসুমে দ্বীপের বাসিন্দারা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করেন। কিন্তু গোটা এলাকা পানিবেষ্টিত হওয়ায় খাওয়া, টয়লেট, যাতায়াতসহ নানান সমস্যার মুখে পড়েন বাসিন্দারা। খোলা আকাশের নিচে থেকেও যেন বন্দিজীবন কাটাতে হয় তাদের।
পানিবেষ্টিত এই মানুষগুলো প্রতিনিয়ত বাঁচে বাঘ ও কুমিরের ভয়ে। আর জীবিকার জন্য লড়াই করেন প্রকৃতি ও দুর্দশার সঙ্গে। বনের মধ্যে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে গেলেও নানা বাধার মুখে পড়তে হয়। প্রাকৃতিক বিপদকে মেনে নিলেও বনদস্যুদের অত্যাচার তাদের কাছে সবচেয়ে ভয়াবহ। দরিদ্র এসব মানুষকে অপহরণ করে দস্যুরা মুক্তিপণ আদায় করে, কেড়ে নেয় তাদের একমাত্র জীবিকাÑ মাছ ধরার নৌকা।
নোনা পানিকে মিষ্টি করতে ব্র্যাকের উদ্যোগ
জয়মনির ঠোটার মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে ব্র্যাক ২০২৪ সাল থেকে চালু করেছে ‘নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’। এখানে নদীর পানি পরিশোধন করে পানযোগ্য করা হয়। তবে সেই পানি কিনতে হয় প্রতিলিটার ৭০ পয়সা দিয়ে। এর আগে তাদের একমাত্র পানির উৎস ছিল বৃষ্টির পানি।
এলাকাবাসী জানান, সরকার তাদের পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাংক দেয়; কিন্তু তা পেতে হলে ঘর হতে হয় টিনের চালার। অথচ বেশির ভাগ মানুষের ঘর গোলপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি, তাই শর্ত পূরণ করতে পারেন না। এ জন্য অনেক পরিবার মিলে একটি টিনের চালা বানিয়ে অনুদানের ট্যাংক সংগ্রহ করেন। বর্ষায় সেই ট্যাংকে পানি জমিয়ে সারা বছর ব্যবহারের চেষ্টা করেন তারা। পানির অভাবে অপচয় বলতে কিছুই নেই তাদের জীবনে।
প্রকল্প টিকে আছে লোকসানে
ব্র্যাকের শাখা ব্যবস্থাপক সঞ্জয় কুমার ম-ল জানান, ‘এলাকার মানুষের প্রয়োজন মেটাতে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। যদিও এই প্লান্ট থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে প্রকল্পের খরচই ওঠে না, তবুও মানবিক সেবামূলক কাজ হিসেবে এটি চালু রাখা হয়েছে।’
ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিলিটার পানির উৎপাদন খরচ এক টাকার বেশি অথচ বিক্রি হয় ৭০ পয়সায়। প্রকল্পে মাসে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় ৭ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া একজন কর্মচারীর মাসিক বেতন ৬ হাজার টাকা। ফলে শুধু বিদ্যুৎ ও বেতনের খরচই দাঁড়ায় মাসে ১৩ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে।
‘লবণমুক্ত নয় পুরোপুরি’Ñ অভিযোগ বাসিন্দাদের
এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘ব্র্যাকের পানি লবণমুক্ত বলা হলেও পুরোপুরি লবণ যায় না। তারপরও এই পানি না কিনে উপায় নেই, কারণ বৃষ্টির পানি দিয়ে সারা বছর চলে না। আর সবার পক্ষে বৃষ্টির পানি ধরে রাখাও সম্ভব হয় না, বড় পাত্রও নেই।’
তবে ব্র্যাক কর্মকর্তারা দাবি করেন, তাদের প্লান্ট থেকে সরবরাহ করা পানিতে কোনো লবণ থাকে না।
নদীর পানি ঘোলা, ব্যবহারেও ঝামেলা
বৃদ্ধ খাদিজা বেগম বলেন, ‘নদীর পানি যেমন লবণাক্ত, তেমনি ঘোলাটে। এতটাই ঘোলা যে তা দিয়ে রান্নাবান্নাও করা যায় না। তবু বাধ্য হয়েই ব্যবহার করতে হয়। আগে পানি সংগ্রহ করে পাত্রে রেখে দিই, কিছুক্ষণ পর কাদা নিচে বসে গেলে ওপরের পানি ব্যবহার করি।’
জেলেপল্লীতে দারিদ্র্যের কশাঘাত
সম্প্রতি জয়মনির ঠোটা ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত নাজুক। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত এ পল্লীতে জাল বা নৌকা বানানোর সামর্থ্য নেই অনেকের। ফলে মহাজন বা আড়তদারদের কাছ থেকে ‘দাদন’ নিয়ে মাছ ধরার সরঞ্জাম তৈরি করেন জেলেরা। কেউ কেউ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে জাল ও নৌকা কেনেন।
সকাল ৭টার মধ্যে পুরো পল্লী পুরুষশূন্য হয়ে যায়। প্রতিবেদক জয়মনির ঠোটায় অবস্থানকালে নারী ও শিশুর বাইরে কোনো পুরুষ দেখা যায়নি। তারা সবাই জীবিকার সন্ধানে নদী ও খাঁড়িতে চলে গেছেন।
বারবার নদীর পাড় ভাঙা-গড়ার কারণে অধিকাংশ ঘরই অস্থায়ী কাঠামোর। খড়কুটা, গোলপাতা বা বাঁশের তৈরি এসব ঘরে উঠান বলতে কিছু নেই। কেউ একটু সচ্ছল হলে টিনের ঘর তুলেছেন। জোয়ারের পানি উঠে গেলে অনেকেই টংঘর তৈরি করে বসবাস করেন।
বনদস্যুদের হাতে বন্দিজীবন
দরিদ্র মানুষগুলো ঋণ বা দাদনের টাকায় যে নৌকা বানিয়ে জীবিকা খোঁজেন, তা মুহূর্তেই কেড়ে নেয় বনদস্যুরা। কখনো নৌকা ছিনতাই করে, কখনো নৌকাসহ মালিককে বন্দি করে মুক্তিপণ দাবি করে।
খাদিজা বেগম বলেন, ‘দস্যুরা যখন পুরুষদের ধরে নেয়, মুক্তিপণ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করায়। সারা দিন নৌকা বাইতে হয়, রান্না করতে হয়, বোঝা টানতে হয়Ñ এর সঙ্গে চলে শারীরিক নির্যাতনও।’
এভাবেই বাঘ, কুমির, দস্যু আর দারিদ্র্যের মধ্যে লড়াই করে টিকে আছে জয়মনির ঠোটার মানুষরা। খোলা আকাশের নিচে থেকেও তাদের জীবন যেন এক অশেষ বন্দিদশা।

