- পাথরঘাটার চরদুয়ানী-কাঁঠালতলী জনপদ ছিল গুম ও আতঙ্কের কেন্দ্র
- রাত হলেই কালো গাড়িতে এসে বাজার খালি করে ট্রলারে লোকজন নিয়ে যেত
- বলেশ্বর নদীর মাঝের একটি চর ‘গুমচর’, সেখানেই করা হতো বিচারবহির্ভূত হত্যা
- লাশের গলায়-পায়ে ইট-সিমেন্ট বেঁধে নদী ও সাগরে ফেলে দেওয়া হতো
- স্থানীয় সোর্স ও নৌকার মাঝিরা সহযোগিতা করত; তাদের কয়েকজন এখন গুম কমিশনের সাক্ষী
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী বাজার ও দক্ষিণ কাঁঠালতলী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ জনপদজুড়ে ছিল এক অদৃশ্য আতঙ্কের রাজত্ব। রাত নামলেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত সতর্কবার্তা, দোকানপাট বন্ধ করতে হবে, সড়ক খালি করতে হবে। মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে যেত চরদুয়ানী-কাঁঠালতলী বাজার। অন্ধকারে ঢুকে পড়ত কালো রঙের ১০-১২টি গাড়ি। স্থানীয়দের ভাষ্য, এ সময় র্যাব সদস্যরা চারদিকে অবস্থান নিলে গাড়ি থেকে নেমে আসতেন তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা কর্নেল (বর্তমানে মেজর জেনারেল) জিয়াউল হাসান।
বাজারের পূর্ব পাশে বরফকল ঘাটে প্রস্তুত থাকত একটি ট্রলার। সেখানেই গাড়ি থেকে নামানো হতো বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে আনা গুম হওয়া ব্যক্তিদের। সেই ট্রলারে তুলে চরদুয়ানী খাল পেরিয়ে বলেশ্বর নদীতে নিয়ে যাওয়া হতো তাদের। নদী থেকে আরও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনা সংলগ্ন একটি চর, যা স্থানীয়দের ভাষায় পরিচিত ‘গুমচর’ নামে, সেখানেই ঘটত বিচারবহির্ভূত হত্যা ও লাশ গুমের নৃশংসতা।
স্থানীয়দের মতে, ট্রলারের ভেতর গুলিতে হত্যা করা হতো ধরে আনা ব্যক্তিদের। এরপর সোর্সদের নির্দেশ দেওয়া হতো বুক ও পেট কেটে গলায় ও পায়ে ইট-সিমেন্টের বস্তা বেঁধে লাশ ফেলে দিতে নদীতে। ভাটির টানে লাশ ভেসে যেত গভীর সমুদ্রে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে ঠা-া মাথায় গুম ও হত্যা চালানো হয়।
স্থানীয়ভাবে সহযোগিতা করতেন কয়েকজন, মোংলার ট্রলার ইঞ্জিন মেকানিক খোকন ফিটার, র্যাবের মাঝি আব্বাস মল্লিক, তার জামাই শাহ আলম, র্যাব জাকির ও জলিল আকন। এদের কেউ কেউ বর্তমানে এলাকায় মাছ ধরা বা অন্য কাজে যুক্ত। কয়েকজন গুম কমিশনের মামলায় সাক্ষী হিসেবেও নাম দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সোর্স আলকাছ মল্লিক নিজেই গুম হয়েছেন, এখনো সন্ধান মেলেনি। সোর্স বলি জাফর মারা যান কয়েক বছর আগে।
চরদুয়ানী ব্রিজ সংলগ্ন টং দোকানদার আব্দুল খালেক জানান, ‘রাত নামলেই র্যাব এসে সবাইকে সরে যেতে বলত। দোকান বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়তাম। বাইরে শুধু ভারী বুটের শব্দ শোনা যেত।’ বরফকল এলাকার বাসিন্দা রিয়াজ বলেন, ‘ওরা যখন আসত, পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে যেত। কেউ জানালা পর্যন্ত খোলার সাহস পেত না।’
স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ী ওয়ালিউল্লাহ বলেন, ‘তারা সিভিল পোশাকে আগে জানিয়ে দিত, আজ অপারেশন আছে, সবাই চলে যান। কিছুক্ষণ পর পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হতো।’ এলাকার তরিকুলের ভাষায়, ‘সাধারণ মানুষের কাছে তখন র্যাব ছিল আতঙ্কের প্রতীক। জলদস্যু দমনের নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজনকে ধরে এনে এখানেই হত্যা করত।’
র্যাবের সোর্স জলিল আকন জানান, ‘সাত হাজার টাকা বেতনে কাজ করতাম। ২০১৭ সালের পর থেকে আর কাজ করি না। এখন নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে। গুম কমিশনের সাক্ষী হওয়ায় মিডিয়ায় কথা না বলার নির্দেশ আছে।’
র্যাবের ট্রলারের মাঝি আব্বাস মল্লিক বলেন, ‘সুন্দরবন ক্যাম্পে সদস্য আনা-নেওয়ার কাজ করতাম। তারা কোথা থেকে লোক আনে, কী করে, এসব জানতে চাইতাম না, সাহসও ছিল না।’
একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন, গত সরকারের সময়ে ভয়ে তারা মুখ খুলতে পারেননি। ‘গুম হওয়ার ভয় ছিল সব সময়,’ বলেন চরদুয়ানীর এক মোটরসাইকেল চালক।
চরদুয়ানী-বলেশ্বর নদীসংলগ্ন এলাকায় এখনো সেই ভয় ও স্মৃতির ছাপ স্পষ্ট। স্থানীয়দের প্রত্যাশা, দীর্ঘদিনের এই অভিযোগ ও ভয়ংকর গুম-হত্যার ঘটনাগুলো সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসবে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

