জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা হয় গত বৃহস্পতিবার। ওই দিন ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি দিয়েছিল কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। এদিন আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার পরও সারা দেশে অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে নৈরাজ্যের চেষ্টা করেন নিষিদ্ধ দলটির অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবারই নির্ধারিত হয় আগামীকাল সোমবার শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ রোববার ও কাল সোমবার সমাজমাধ্যমে শাটডাউনর কর্মসূচির ডাক দিয়ে দেশ অচল করার ঘোষণা দিয়েছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ।
এদিকে শাটডাউন কর্মসূচি ঘিরে দেশজুড়ে নৈরাজ্য-নাশকতার আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কর্মকর্তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের শাটডাউন কর্মসূচি নিয়ে দেশজুড়ে নৈরাজ্য-নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে। শেখ হাসিনার রায় ঘিরে মাঠে নামার চেষ্টায় রয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। তবে এসব নৈরাজ্য প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশ আজ থেকে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে। সেই সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান। এর মধ্যেই দেশবিরোধী আপরাধে যুক্ত থাকায় ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে প্রায় ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান, বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল কার্যক্রম। ঢাকা ও আশপাশের জেলায় নেমেছেন বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া বিভাগীয় শহরসহ সারা দেশের নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে।
নাশকতার আশঙ্কায় দেশজুড়ে সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: এর আগে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পরিবহনসংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়।
গোয়েন্দারা বলছেন, অপরাধীরা এ পর্যন্ত ১৫টি গাড়িতে আগুন ও অর্ধশতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব অপরাধে যুক্ত থাকায় চলতি মাসের গত ১৫ দিনে শতাধিক নৈরাজ্যকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার পরও শাটডাউন কর্মসূচির ঘোষণায় উৎকণ্ঠায় দেশবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ ক্লাস হবে। সে জন্য মোড়ে মোড়ে সতর্ক অবস্থায় থাকবে পুলিশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী গতকাল শনিবার রাত থেকেই ঢাকা ও আশপাশের জেলায় মোতায়েন করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ ছাড়া আবাসিক হোটেলের রেজিস্টার খাতা দেখে কারা সেখানে অবস্থান করছেন, তা-ও খুঁজে দেখছে পুলিশ।
৬৪ জেলার ডিসি ও পুলিশ সুপারকে নিয়ে বৈঠক : শাটডাউন কর্মসূচিতে নাশকতা ঠেকাতে গতকাল ৬৪ জেলার ডিসি ও পুলিশ সুপারকে নিয়ে বৈঠক করেছে সরকার। এদিকে আজ ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি থাকলেও সারা দেশে গণপরিবহন চলবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সংগঠনটির পক্ষ থেকে শ্রমিকদের সতর্কভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় নজরদারি ও আগাম তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা চলমান। অবৈধ কর্মকা-, নাশকতা বা সংঘর্ষের চেষ্টা হলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শাটডাউনে নাশকতা ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। এরই মধ্যে বাড়তি নিরাপত্তা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হয়েছে তৎপরতা। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেদিকে চোখ রাখছে সব থানার পুলিশ ও ডিবির টিম।
ডিএমপির আট বিভাগের প্রায় ২০০ পয়েন্টকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা করেছে। প্রতিটি বিভাগের ডিসিদের তদারকিতে এই নিরাপত্তা ছক সাজানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, ‘যেকোনো ধরনের নাশকতা বা অরাজকতা ঠেকাতে পুলিশ সব সময় তৎপর। ঢাকা নগরী নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে। সেই সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চলছে এবং যেকোনো ঘটনা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে।’
শাটডাউন কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে উল্লেখ করে ডিএমপির পক্ষ থেকে জাননো হয়, শাটডাউন ঘিরে বাড়তি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আট বিভাগের প্রায় ২০০ স্পটে ‘অনগার্ড মোবিলাইজেশন ড্রিল’ করেছে পুলিশ। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা, জাতীয় প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ সচিবালয়, হাইকোর্ট, সংসদ ভবন, বঙ্গভবন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় চলে পুলিশের এই মহড়া।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেছেন, শেখ হাসিনার রায়কে ঘিরে মাঠে নামার চেষ্টায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যে গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। দেশজুড়ে নৈরাজ্য-নাশকতার শঙ্কায় নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে সারা দেশ। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চলমান থাকবে।
এ বিষয়ে বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, শাটডাউন কর্মসূচি ঘিরে যেকোনো ধরনের নাশকতা রোধে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে, মাঠে সংস্থাটি কাজ করছে। কেউ নাশকতার চেষ্টা করলে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় নজরদারি ও আগাম তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা আছে।’
তিনি আরও বলেন ‘ওপেন সোর্স থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আমাদের গোয়েন্দা ও সাইবার মনিটরিং টিম সক্রিয় রয়েছে। সুনির্দিষ্ট আশঙ্কা না থাকলেও র্যাব সর্বোচ্চ প্রস্তুত। অতিরিক্ত টহল ও চেকপোস্ট স্থাপনের কাজ চলছে।’
পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘১৭ নভেম্বর ঘিরে বড় কোনো সহিংসতার নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর অপপ্রচার চলছে। আমরা এসব তথ্য হালকাভাবে নিচ্ছি না। রাজধানীসহ সারা দেশে চেকপোস্ট বৃদ্ধি, তল্লাশি ও অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
ঢাকা জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ নাশকতার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কাল ঢাকার প্রবেশপথ, হোটেল, মেস ও বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোয় বিশেষ তল্লাশি শুরু হবে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েনের কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে হাসিনার রায় ঘিরে বিশৃঙ্খলার কোনো শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
মাঠে নামার চেষ্টায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আ.লীগ : এদিকে রায়কে কেন্দ্র করে মাঠে নামার চেষ্টা করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। দলটির ঘোষিত ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি নিয়ে ইতোমধ্যে দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক সম্প্রতি এক ভিডিও বার্তায় ১৫ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ এবং ১৭ নভেম্বর ‘ঢাকা শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচির পক্ষে অনলাইনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে উঠেছেন আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা। এরপর থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে, যা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

