- ইইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ ৫ কর্মকর্তা ও ১০ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু
- দেশজুড়ে অন্তত ৭ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অগ্রিম বিল তুলেছেন চারশরও বেশি ঠিকাদার
- ঠিকাদারদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতা কিংবা তাদের অনুসারী
- প্রায় দুইশ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ঠিকাদার
- ইইডির অভিযুক্ত ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রভাবিত করার অভিযোগ
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রায় ৩২ কোটি টাকার ভবন নির্মাণের কাজ ইলেকট্রো গ্লোব মিরন এন্টারপ্রাইজকে পাইয়ে দিতে প্রাক্কলিত ব্যয় ফাঁস করার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের মালিক যুবলীগ নেতা রাকিব হোসেন গ্রেপ্তার হয়েছেন। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি প্রকৌশলী আসাদ, একইভাবে রূপগঞ্জের পূর্বাচল মাধ্যমিক সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৩৫ কোটি টাকার কাজ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের শ্বশুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূরানি কনস্ট্রাকশনকে পাইয়ে দিতে প্রাক্কলিত ব্যয় কমিয়ে ফাঁস করেন। শুধু আসাদ নয়, তার মতো সারা দেশে অনেক প্রকৌশলীই আওয়ামী সরকারের ঠিকাদারদের কাজের থেকে অতিরিক্ত বিল দিয়েছেন। সরকার পতনের পর এসব ঠিকাদার লাপাত্তা হয়ে যাওয়া বন্ধ রয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণকাজ। অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাজ ও অগ্রিম বিল দেওয়ায় এবার নড়েচড়ে বসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইইডির পাঁচ কর্মকর্তা ও দশ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে তদন্ত।
গত ১২ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (শৃঙ্খলা বিষয়ক শাখা) আশরাফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ থেকে এ তথ্য জানা যায়। এ তালিকায় ইইডির কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) জরজিসুর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পিআরএল ভোগরত) মীর মুয়াজ্জেম হোসেন, উপসহকারী প্রকৌশলী এ কে এম মনিরুজ্জামান ও জামিল হোসেন। এ ছাড়া ঠিকাদারদের মধ্যে রয়েছেনÑ আশা এন্টারপ্রাইজের আশা আক্তার, সৌরভী এন্টারপ্রাইজের আমজাদ হোসেন, এক্সপার্ট বিল্ডার্স অ্যান্ড ইন্টারিয়ালের ফারসাদুর হক সৌরভ, ফাতেমা কনস্ট্রাকশনের রাজীবুল ইসলাম, জাকিয়া এন্টারপ্রাইজের রাকিবুল হাসান রাসেল, আস্থা মেশিনারিজের রাশেদ খান, ট্রেইঙ্গেল করপোরেশনের এ কে এম সাজ্জাদ হোসেন, ভূইয়া কনস্ট্রাকশনের ওজাইফা আক্তার, সামি এন্টারপ্রাইজের রঞ্জু মিয়া, মাশফি এন্টারপ্রাইজের মাহাবুবুর রহমান ও সাহানা কনস্ট্রাকশনের ইমতিয়াজ হাসান সিদ্দিকী।
অফিস আদেশে বলা হয়, ইইডি ঢাকা-এর কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং অন্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এ বিষয়ে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরেজমিনে তদন্ত করে সুস্পষ্ট মতামতসহ তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানোর অনুরোধ করা হলো।
এ প্রসঙ্গে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী তারেক আনোয়ার জাহেদী বলেন, ‘যেহেতু তদন্ত চলমান, তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। আর এ অভিযোগগুলো আমার দায়িত্ব গ্রহণের আগের প্রধান প্রকৌশলীর সময়ের।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আসাদুজ্জামান ছাড়াও ঢাকার বাইরে নাটোরের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় লালপুর উপজেলাধীন বিলগারি দাখিল মাদ্রাসা, সদর উপজেলার বারঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজের অগ্রিম বিল দেওয়া, রংপুরে ২০ কোটি টাকার দরপত্রে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্রের শর্তে কোল্ড স্টোরেজ অন্তর্ভুক্ত করারও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতিতে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) জালিয়াতিরও অভিযোগ উঠেছে।
এসব বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, নাটোরে কর্মরত থাকাকালীন আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। আর তার সর্বশেষ এসিআরে যা লেখা ছিল তাতে তার পদোন্নতি হওয়ার কথাই না। কারণ তার এসিআরে বিরূপ মন্তব্য ছিল। এসিআরটি যাচাই করলেই জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের ভাষ্য, তদন্ত চলছে, তাই কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
ইইডি সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পর তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল সোমবার বিকেলে পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের শুনানির জন্য ডেকেছেন।
তবে ইইডির প্রধান কার্যালয়ের তদন্ত কার্যক্রম নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক কর্মকর্তা। তাদের ভাষ্য, প্রধান দুই অভিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান ও নির্বাহী প্রকৌশলী জরজিসুর রহমান প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত থেকে তদন্ত কার্যক্রমকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা ও ইইডির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মামুনুর রশিদ ও জরজিসুর রহমানের গ্রামের বাড়ি একই জেলায় এবং তারা পূর্বপরিচিত হওয়ায় তদন্তের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এই পাঁচ প্রকৌশলী আর দশ ঠিকাদার ছাড়াও আরও সারা দেশের অধিকাংশ প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে অগ্রিম বিল দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি সিলেট জেলার নির্মাণাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে এসে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে তারা উল্লেখ করেন, সিলেট জেলার অন্তত ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের কাজ শেষ না করেই গত ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদাররা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তাদের অধিকাংশ লাপাত্তা। এ ছাড়া বিগত ৫ বছরে সিলেটে যে নির্মাণকাজ হয়েছে, তার অধিকাংশই নি¤œমানের বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। সিলেটসহ সারা দেশে অন্তত ৭ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ২০০ কোটি টাকার বেশি অগ্রিম বিল ৪ শতাধিক ঠিকাদার তুলে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইইডির সংশ্লিষ্টরা।
ইইডির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি কাজে ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন করে বিল নিতে হয়। অর্থাৎ যতটুকু কাজ শেষ হয়েছে সেই পরিমাণ বিল পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সারা দেশের অধিকাংশ জেলায়ই এসব নিয়ম মানা হয় না। কাজ না করেই ইইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে অগ্রিম বিল তুলে নেন ঠিকাদাররা। এই অগ্রিম বিল নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিতে হয় ভাগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার জানান, ঠিকাদাররা চাইলেই কি অগ্রিম বিল তুলতে পারেন? অগ্রিম বিল তুলতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের ভাগ দিতে হয়। ঠিকাদার ও ইইডির কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই অগ্রিম বিল তোলা হয়।
দেশের ১০ জেলার প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কাজ পাওয়া বেশির ভাগ ঠিকাদারই আওয়ামী লীগের নেতা কিংবা দলটির অনুসারী। সরকার পতনের পর তারা বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এর মধ্যে অনেকে জেলহাজতে আবার কেউ কেউ দেশ ছেড়েও পালিয়েছেন। যার ফলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। তবে কোনো কোনো ঠিকাদারের আত্মীয়-স্বজনকে ম্যানেজ করে কাজ উদ্ধার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) সাইদুর রহমান বলেন, ইইডির তদন্ত কার্যক্রমের ওপর আমাদের নজরদারি থাকবে। এ ক্ষেত্রে কারো গাফিলতি বা অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না। আরও অভিযোগ থাকলে সেগুলোও তদন্ত করা হবে।
প্রসঙ্গত, ইইডি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনের সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, সংস্কার এবং আসবাব সরবরাহ করে। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও আইসিটি ল্যাব স্থাপন, ইন্টারনেট সংযোগ, আইসিটি সুবিধা দেওয়ার কাজও করে থাকে অধিদপ্তরটি।

