* একনেকে জুলাই শহিদ পরিবারের আবাসনসহ ১৭ প্রকল্প অনুমোদন
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমার ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বেশি সংস্কার করে ফেলেছে। অনেক উচ্চাবিলাসী সংস্কার করেছে। নির্বাচিত সরকারের পক্ষে এত সংস্কার হজম করা একটু কঠিন হতে পারে। বেশির ভাগ সংস্কার কিংবা সংস্কারের নির্যাস গ্রহণ করবে বলে আশা করি।’
গতকাল সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা এবং একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক সভায় হয়।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা অনেক অধ্যাদেশ রেখে যাচ্ছি। যেমন বিচার বিভাগকে স্বাধীন করার একটা অধ্যাদেশ হলো। তাদের হাতে বেশি স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না, তা নতুন সরকার এসে নিশ্চয়ই আবার দেখবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর মনে হতে পারে।’
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার মানে হলো, আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে অনেক কিছু থাকছে না। বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে গেছে। এগুলো অনেক বড় বড় সংস্কার হচ্ছে।
এ সময় ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বিভিন্ন খাতের সংস্কার কমিটি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ক্রয় নীতিমালাসহ বিভিন্ন সংস্কার তুলে ধরেন। পরবর্তী জাতীয় সংসদ এসব অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করে আইন করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, প্রকল্প পরিচালকদের সমস্যা রয়েই গেছে। মুশকিল হলো যে, এখন কেউ প্রকল্প পরিচালক হতে চাচ্ছেন না। আর ঠিকাদারেরাও এখন বেশি উৎসাহী হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘যত দূর শুনেছি, দুর্নীতি খুব কমেনি বা চাঁদাবাজি... এসবও শুনি।’
চলমান অস্থিরতা ও দাবি-দাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের হাতে সময় খুবই কম। অথচ এই সময়ে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষকরা ধর্মঘটে যাচ্ছেন, যখন কি না সামনেই পরীক্ষা। সবার মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, এটাই শেষ সুযোগ, এখনই যা পারো আদায় করো। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হয়ে গেলে আর কিছু করা যাবে নাÑ এমন ভাবনা থেকে দুদিনের আলটিমেটাম দেওয়া হচ্ছে। এটি আমার কাছে অদ্ভূত লাগে।
সর্বস্তরে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, আমরা কি খুব অস্থির হয়ে গেছি? এখনই না পেলে আর কখনো পাব না, এমন মনে হয় কেন? এই অস্থিরতা থেকে সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষক ও ছাত্র সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।
‘দেশ ভালো হোক তা সবাই চায়। কিন্তু তার জন্য একটি সুস্থির পরিবেশ দরকার, যেখানে ছাত্ররা পড়বেন, গবেষকরা গবেষণা করবেন এবং পরিকল্পনাবিদরা পরিকল্পনা করবেন। দেশের সব সমস্যার দায় মাথায় নিয়ে কেউ টিকতে পারে না। নিজের জায়গায় দায়িত্ব পালন করলেই দেশ এগিয়ে যাবে’Ñ যোগ করেন উপদেষ্টা।
গতকালের সভায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবারের স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণসহ মোট ১৭টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ১৫ হাজার ৩৮৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত এসব প্রকল্পের মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ৯ হাজার ৪৫১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ ৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা ৭০ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৩৭৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর মধ্যে নতুন প্রকল্প ১২টি এবং সংশোধিত প্রকল্প ৫টি।
সভায় অনুমোদিত ১৭টি প্রকল্প হলো : কৃষি মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্পÑ (১) চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চলের টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (২) মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প। বিদ্যুৎ, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্পÑ (১) ১৩টি অনুসন্ধান কূপ (শ্রীকাইল ডিপ-১, মোবারকপুর ডিপ-১ ও ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ-১) খনন প্রকল্প (২) সোনাগাজী ২২০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ৩টি প্রকল্পÑ (১) ঢাকার মিরপুর ৯নং সেকশনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪ এ কর্মক্ষমতা হারানো জুলাই যোদ্ধা পরিবারের স্থায়ী বাসস্থান প্রদানের নির্মিত ১৫৬০টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প (২) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২৪ এ শহিদ পরিবারের স্থায়ী বাসস্থান প্রদানের নিমিত্ত জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জমিতে ‘৩৬ জুলাই’ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প (৩) বাংলাদেশ সচিবালয়, পরিবহনপুল, মিনিস্টার্স এপার্টমেন্ট ও সচিব নিবাসের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিদ্যমান বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক ও অগ্নিসরঞ্জামাদির আধুনিকায়ন প্রকল্প। সেতু মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্পÑ (১) ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (লাইন-৬) (৩য় সংশোধিত) প্রকল্প (২) সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগাধীন সিরাজগঞ্জ-রায়গঞ্জ (চান্দাইকোনা) (জেড-৫০৪২) জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, নারায়ণগঞ্জ সবুজ ও স্থিতিশীল নগর উন্নয়ন প্রকল্প (এনজিআরইউডিপি)। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, অটিজম ও এনডিডি সেবাদান কেন্দ্র (২য় সংশোধন) প্রকল্প। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, জাপান মানবসম্পদ উন্নয়ন বৃত্তি প্রকল্প (জেডিএস) (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম উন্নয়ন (১ম সংশোধন) প্রকল্প। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় একাডেমিক ও কেন্দ্রীয় গবেষণাগার (১০তলা ভিতে ১০ তলা) ও অন্যান্য ভবন নির্মাণ কাজ সমাপ্তকরণ প্রকল্প। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রকল্প (১) ফলাফলের জন্য জলবায়ু প্রতিক্রিয়াশীল প্রজনন স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যা পরিষেবা উন্নয়ন এবং সিস্টেম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প (২) মুন্সীগঞ্জে এসেনশিয়াল বায়োটেক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প (৩) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট-সংস্থাসমূহের অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে।
সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা কর্তৃক ইতোমধ্যে অনুমোদিত ৫০ কোটি টাকার কম ব্যয় সম্বলিত ১৫টি প্রকল্প সম্পর্কে একনেক সভায় অবহিত করা হয়।
সেগুলো হলো : ১. বাংলাদেশ বেতার, চট্টগ্রাম কেন্দ্র আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল সম্প্রচার যন্ত্রপাতি স্থাপন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প ২. কুমিল্লা জেলাস্থ মুরাদনগর উপজেলায় বিদ্যমান মিনি স্টেডিয়াম উন্নয়ন, নোয়াখালী জেলাস্থ সেনবাগ উপজেলা স্টেডিয়াম উন্নয়ন এবং মাগুরা জেলা স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সে ডরমিটরি ভবন নির্মাণ প্রকল্প ৩. দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রযুক্তিনির্ভর সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা (ইমপ্যাক্ট-৩য় পর্যায়) (২য় সংশোধিত) ৪. খুলনা পাবলিক কলেজ, বয়রা, খালিশপুর এর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ৫, ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটিজ (৩য় সংশোধিত) প্রকল্প ৬. ঢাকা মাদারীপুর ও রংপুর জেলার তিনটি কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন (১ম সংশোধন) প্রকল্প ৭. শহীদ মো. সামিদ হোসেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ (১ম সংশোধিত) ৮. নোয়াখালী জেলাস্থ শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামের অধিদপ্তর উন্নয়ন প্রকল্প ৯. বিয়াম ফাউন্ডেশনের আওতায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কাম ডরমেটরি ভবন নির্মাণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প ১০. কক্সবাজার জেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্ত নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদী বরাবর পোন্ডারসসমূহের (৬৭/এ, ৬৭, ৬৭/বি এবং ৬৮) পুনর্বাসন (২য় সংশোধিত) ১১, জবই বিল ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিলসমূহের মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প ১২. গাজীপুর জেলার পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন (১ম সংশোষিত) ১৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম সবুজায়নের মাধ্যমে বন জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধকরণ ১৪, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পৌর এলাকার নবাব খাল, নয়াগোল খাল এবং রেলওয়ের বরো পিট খনন/পুনঃখননের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প ১৫. দিনাজপুর পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন (২য় সংশোধিত)।
সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, খাদ্য এবং ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.), শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম এবং শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরারসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা সভায় অংশগ্রহণ করেন।

