সিলেটের জ্বালানি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আজ মঙ্গলবারের মধ্যে ডিপোতে থাকা অবশিষ্ট জ্বালানি তেল বিক্রি করে ফেলবে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানি। এরপর খালি হয়ে পড়বে ডিপোগুলো। কারণ, চট্টগ্রাম থেকে তেলের কোনো ওয়াগনই সিলেটে এসে পৌঁছেনি। চলতি মাসে সহসা আসারও লক্ষণ নেই। ফলে আগামীকাল বুধবার থেকে সিলেটের পেট্রোল পাম্পগুলো স্থানীয় ডিপোগুলো থেকে চাইলেও আর জ্বালানি তেল পাবে না। এ সময় শূন্যের কোটায় পৌঁছাবে জ্বালানি মজুত। ফলে ওইদিন থেকে কার্যত সিলেটে জ্বালানি তেলের পূর্ণ সংকট শুরু হবে। সংকট চোখের সামনে দৃশ্যমান হলেও তা মোকাবিলায় কার্যত কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এজন্য তেল ডিপোগুলো দুষছে বাংলাদেশ রেলওয়েকে। রেলওয়ে ওয়াগন প্রস্তুত থাকলেও ইঞ্জিন সংকটে যথাসময়ে সিলেটে তেলবাহী গাড়ি পৌঁছাতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় সিলেটের তেল ব্যবসায়ীরা।
সূত্র জানায়, সিলেটে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে মোট জ্বালানি তেলের ধারণক্ষমতা ৪৬ লাখ ২০ হাজার লিটার। এর মধ্যে ডিজেল ৪০ লাখ লিটার, পেট্রোল ৫ লাখ লিটার, অকটেন ১ লাখ ২০ হাজার লিটার। প্রতিদিন তাদের জ্বালানি চাহিদা ৩ লাখ ৫০ হাজার লিটার। পদ্মা অয়েল কোম্পানির ধারণক্ষমতা ১৭ লাখ ৩৫ হাজার লিটার। এর মধ্যে ডিজেল ১৬ লাখ লিটার, পেট্রোল ৯০ হাজার লিটার এবং অকটেন ৪৫ হাজার লিটার। প্রতিদিনের চাহিদা ৩ লাখ লিটার। মেঘনা অয়েল কোম্পানির ধারণ ক্ষমতা ২৪ লাখ ১৪ হাজার লিটার। এর মধ্যে ডিজেল ১৬ লাখ লিটার, পেট্রোল ৪ লাখ ৬৪ হাজার লিটার এবং অকটেন ৩ লাখ ৫০ হাজার লিটার। তাদের প্রতিদিনের চাহিদা ২ লাখ লিটার। তবে কখনই এই তিন ডিপোর কোনোটিই ধারণ ক্ষমতার পুরো তেল নিজেদের কাছে মজুত রাখতে পারেনি।
যমুনা অয়েল কোম্পানি রেলপথ ছাড়াও নদীপথে সিলেটে জ্বালানি তেল নিয়ে আসে। ভরা বর্ষায় সেটি সহজ হলেও খরা মৌসুমে কার্গো জাহাজে করে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট অব্দি তেল নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। কোম্পানি সূত্র জানায়, তারা রেলের দিকে না তাকিয়ে নিজেরা কার্গো জাহাজে করে সিলেটে তেল এনে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে সিলেটের নদীপথ সুরমায় পানিপ্রবাহ একেবারে কমে গেলে নানান স্থানে নাব্য সংকট তৈরি হয়েছে। এজন্য সর্বশেষ চালান গত রোববারে আনা সম্ভব হলেও আগামী পুরো মৌসুমে নদীপথে তেলের কোনো চালান আনতে পারবে না। ফলে সংকট মোকাবিলায় তাদের বিকল্প উদ্যোগও ওই সময় কাজে আসবে না। যমুনা নদীপথে প্রতি জাহাজে এক সঙ্গে ৫ লাখ লিটার তেল আনতে পারলেও রোববার সর্বশেষ যে জাহাজ সিলেট তেল জেটিতে এনে ভিড়াতে পেরেছে, নাব্য সংকটের কারণে সেটিতে ৪ লাখ লিটার তেল তারা পরিবহন করতে পেরেছে। যমুনা ছাড়া বাকি দুটো কোম্পানি পদ্মা অয়েল পিএলসি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামকে রেলওয়ে ওয়াগনের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হয়।
এদিকে তেল সংকট দেখা দেবেÑ এমন আশঙ্কা আঁচ করতে পেরে কোম্পানিগুলো আগেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে জানিয়েছে। এমনকি সিলেটের ফিলিং স্টেশনের মালিক ও ব্যবসায়ীদেরও তারা বিষয়টি অবহিত করে বিকল্প উপায়ে আপৎকালীন সময়ে তেল সংগ্রহের কথা জানায়। সিলেট গ্যাস ফিল্ড থেকে তেল সংগ্রহের সুযোগ আছে। তবে সেখান থেকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও চাহিদামতো তেল পায় না পাম্পগুলো। সিলেট গ্যাস ফিল্ড বরং পাইপ লাইনের মাধ্যমে তেল পরিশোধনের দোহাই দিয়ে তা উত্তরবঙ্গে পাঠিয়ে দেয়। এনিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ রয়েছে। তারা এটি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে জানালেও কোনো কাজ হয়নি।
সিলেটের ব্যবসায়ীরা তেলের সংকট সমাধানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আশ্রয় নেন। কর্তৃপক্ষ রেলের ওয়াগন আসার আগ পর্যন্ত তেল সংকট মোকাবেলায় ভৈরব ও আশুগঞ্জ তেলডিপো থেকে জ্বালানি সংগ্রহের পরামর্শ দেয়। তবে এ পরামর্শ সিলেটের ব্যবসায়ীরা মানতে নারাজ। কারণ, ওখান থেকে গাড়িতে করে তেল আনতে গেলে একদিকে ব্যয় বেড়ে যায়। অপরদিকে আশুগঞ্জের পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডিপো প্রতি গাড়িতে তেল সরবরাহে কারচুপি করে। গাড়িপ্রতি অন্তত ১০০ লিটার তেল তারা ওজনে কম সরবরাহ করে। এতে অন্তত ১০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয় তেল ব্যবসায়ীদের। পদ্মার অসাধু কর্তাদের এ কারচুপির বিষয়টি সিলেটের ব্যবসায়ীরা লিখিতভাবে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে জানিয়েছেনও। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিষয়টি বিএসটিআইকে জানানোর। ব্যবসায়ীরা সিলেট বিএসটিআইকে জানানও। তবে আশুগঞ্জ ঢাকা বিএসটিআইর অধীনে হওয়ায় তাদের পরামর্শ দেওয়া হয় ঢাকায় অভিযোগ দিতে।
ব্যবসায়ী সূত্র জানায়, সিলেট থেকে তেলের ফিরতি ওয়াগন চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। সেখানে লোডও হবে জ্বালানি তেল। কিন্তু সেটি সিলেটের পথে কবে রওনা দেবে তা কেউ জানেন না। রেল সূত্র জানায়, রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে আগে যেখানে সপ্তাহে দুটি চালান আসত, সেখানে এখন দুই সপ্তাহেও একটি চালান আসছে না। এটি রেলের ইঞ্জিন সংকটের কারণেই হচ্ছে। সিলেট রেলওয়ের স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম জানান, মূলত ইঞ্জিন সংকটের কারণে ওয়াগনগুলো লোড থাকার পরও সিলেটের পথে রওনা দিতে পারে না। লোকো সংকটে যাত্রীবাহী ট্রেন যোগাযোগ সচল রাখতে সেগুলো যাত্রী পরিবহনে ব্যস্ত থাকে। ফলে চাইলেই তেল পরিবহনের জন্য ইঞ্জিন দেওয়া যায় না।
সিলেটের জ্বালানি তেল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলারস, ডিস্ট্রিবিউটরস, এজেন্টস্ অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, ব্যবসায়ীরা সংকট আগে থেকে অনুমান করতে পেরেছিলেন বলেই তারা এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে ধরনা দিয়েছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সিলেটের জেলা প্রশাসক সারওয়ার আলম এবং গত ২৭ সেপ্টেম্বর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে নেতারা পৃথক বৈঠক করেন।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলারস, ডিস্ট্রিবিউটরস, এজেন্টস্ অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন আহমেদ বলেন, সংকট তৈরি যে সোর্স থেকে হচ্ছে, সেখানে সমাধানের কথা আমরা বারবার বলেছি। কিন্তু হচ্ছে না। যে ওয়াগন আসার কথা সেগুলোও আসছে না। দুয়েক দিনের মধ্যে এসব কারণে সিলেটে তেল সংকট দেখা দেবে। এটি কাটিয়ে ওঠা মুশকিল হতে পারে। সিলেট গ্যাস ফিল্ড এগিয়ে না এলে এটি আরও ঘনীভূত হবে। তারা চাহিদামতো তেল সরবরাহ করলে আপৎকালে সংকট মোকাবিলায় সামান্য হলেও ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বরাবরই তারা এ নিয়ে খুব একটা আন্তরিকতা দেখায় না।
যমুনা অয়েল কোম্পানির সিলেটের ডিপো ইনচার্জ খাইরুল কবির দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যেখানে আমাদের ডিপোতে প্রতিদিন চাহিদা সাড়ে তিন লাখ লিটার, সেখানে ১৫ দিনেও রেলের ওয়াগনে করে দেড় লাখ লিটার তেল আসে না। এ অবস্থায় সংকট মোকাবেলা কতটা কঠিন তা সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, সিলেটে আমাদের নিজস্ব জেটি পয়েন্ট থাকায় আমরা কার্গো জাহাজে করে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫ লাখ লিটার তেল আনতে পারি। কিন্তু সুরমায় নাব্য সংকটে সেই সুযোগও এখন সংকুচিত। পুরো শুকনো মৌসুমে নদীপথে তেল পরিবহন করা যাবে না। এখন একমাত্র উপায় রেলের ওয়াগন। এ অবস্থায় ইঞ্জিন সংকট কাটিয়ে সিলেটকে জ্বালানি তেল সরবরাহ না করলে সংকট চরম আকার ধারণ করবে। আজকালের মধ্যে তেলের মজুত শূন্যে চলে যাবে। পদ্মা অয়েল কোম্পানির সিলেট ডিপোর ইনচার্জ আখের আলী দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি ওয়াকিবহাল করেছি। রেলের পাওয়ার কার সংকটের কারণে তেল আসতে পারছে না। এতে আমাদের হাত নেই। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডিপো ইনচার্জ মো. আবু সাঈদ বলেন, আমরা পুরোপুরি রেলের ওয়াগনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে রেল আমাদের জ্বালানি তেল পরিবহন নিশ্চিত না রাখলে সংকটে পড়তে হয়। দ্রুততার সঙ্গে বিষয়টি রেলকেই ভাবতে হবে।

