ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৫

এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়েও যে সাহাবি জান্নাতি

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২৫, ০১:০৩ এএম
ছবি- সংগৃহীত

হজরত আমর ইবনুস সাবিত। যিনি আল-উসাইরিম নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন মদিনার আওস গোত্রের বানু আবদুল আশহাল বংশের একজন সাহাবি। তিনি উহুদের যুদ্ধের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সেদিনই শহীদ হয়ে যান।

জীবনে তার এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করারও সুযোগ হয়নি। কিন্তু এ খবর রাসুলুল্লাহকে (সা.) জানানো হলে তিনি ঘোষণা করলেন— ‘নিশ্চয়ই তিনি জান্নাতবাসীদের একজন।’

হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তার বিষয়টি এভাবে ওঠে এসেছে—

হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলতেন, ‘তোমরা আমাকে এমন একজন ব্যক্তির কথা বলো, যিনি কখনো একবারও নামাজ পড়েননি, তবুও জান্নাতে প্রবেশ করেছেন।’

লোকেরা যখন তাকে চিনতে পারতেন না, তখন তিনি বলতেন— ‘তিনি হলেন আল-উসাইরিম, বানু আব্দুল আশহাল গোত্রের আমর ইবনু সাবিত।’

হজরত হুসাইন (রহ.) বলেন, আমি মাহমুদ ইবনু লাবিদকে জিজ্ঞাসা করলাম— ‘আল-উসাইরিমের ঘটনা কী?’

তিনি বললেন, ‘তার গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি নিজে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করতেন। কিন্তু উহুদের দিন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) উহুদের দিকে যাত্রা করলেন, তখন তার অন্তরে ঈমানের আলো উদ্ভাসিত হলো। তিনি সেদিনই ইসলাম গ্রহণ করেন।

এরপর তিনি অস্ত্র ধারণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে মুসলমানদের সারিতে যোগ দেন এবং যুদ্ধ করতে করতে গুরুতরভাবে আহত হন।’

বর্ণনায় আছে— উহুদের যুদ্ধ শেষে বানু আব্দুল আশহালের লোকেরা শহীদদের খোঁজ করছিলেন। তারা আমরকে (আল-উসাইরিম) আহত অবস্থায় পেলেন। বললেন, ‘এ তো আল-উসাইরিম! তিনি এখানে কেন? আমরা তো তাকে ইসলাম থেকে বিরত অবস্থায় রেখে এসেছিলাম।’

তারা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমর! তোমাকে কে এখানে এনেছে? তুমি কি তোমার গোত্রের জন্য যুদ্ধ করতে এসেছ, নাকি ইসলাম গ্রহণের জন্য?’

তিনি বললেন, ‘বরং ইসলামের প্রতি আগ্রহেই আমি এসেছি। আমি আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছি। ইসলাম গ্রহণ করেছি। তারপর আমার তরবারি নিয়েছি এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছি।

যুদ্ধ করতে করতে যা আমাকে করেছে তাই হয়েছে- এই কথা বলেই তিনি তাদের হাতের ওপরই মৃত্যুবরণ করেন। যখন এ ঘটনা রাসুলুল্লাহকে (সা.) জানানো হলো, তিনি বললেন— ‘সে তো জান্নাতবাসীদের একজন।’ (মুসনাদ আহমদ)

হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ আবু দাউদের এক বর্ণনায় এসেছে—

হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, আমর ইবনু উকাইশ জাহিলিয়া সময়ে কিছু লোকের কাছে সুদের টাকা পেতেন। সে কারণে তিনি ইসলাম গ্রহণ করতে দেরি করছিলেন— ভাবতেন, ইসলাম নিলে আর হয়তো সুদের টাকা আদায় করতে পারবেন না।

উহুদের দিন তিনি বললেন, ‘আমার চাচাতো ভাইয়েরা কোথায়?’ তারা বলল, ‘উহুদে।’ তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অমুক কোথায়?’ তারা বলল, ‘উহুদে।’ ‘অমুক কোথায়?’ তারা বলল, ‘উহুদে।’ তখন তিনি যুদ্ধের পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা হলেন।

মুসলমানরা তাকে দেখে বলল, ‘আমর! আমাদের দিক থেকে সরে দাঁড়াও (অর্থাৎ ভেবেছিল তিনি এখনো মুসলমান নন)।’

তিনি বললেন, ‘আমি ঈমান এনেছি।’ এরপর তিনি যুদ্ধ করতে লাগলেন এবং গুরুতর আহত হলেন। তাকে আহত অবস্থায় তার পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।

তারপর হজরত সাদ ইবনু মুয়াজ (রা.) তার বাড়িতে গিয়ে তার বোনকে বললেন, ‘তাকে জিজ্ঞাসা কর—সে কি তার গোত্রের প্রতি গর্বের বশে যুদ্ধ করেছে, নাকি গোত্রের পক্ষ হয়ে, নাকি আল্লাহর জন্য?’ তিনি (আমর) বললেন, ‘বরং আল্লাহ ও তার রাসুলের জন্য।’ এরপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং একবারও নামাজ পড়ার সুযোগ না পেলেও জান্নাতে প্রবেশ করেন।’

সহিহ বুখারিতে এমন আরেকটি হাদিস এসেছে, যা এ ঘটনার সত্যতাকে আরও স্পষ্ট করে। হজরত বরাআ ইবনু আজিব (রা.) বর্ণনা করেন, ‘এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ লোহার বর্ম পরে— মুখও ঢাকা অবস্থায়—নবী (সা.)–এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল!, আমি কি আগে যুদ্ধ করব, নাকি আগে ইসলাম গ্রহণ করব?’

নবী (সা.) বললেন, ‘ইসলাম গ্রহণ কর, তারপর যুদ্ধ কর।’ তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর যুদ্ধে অংশ নিলেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। এ ঘটনা দেখে নবী (সা.) মন্তব্য করলেন, ‘সে অল্প কাজ করল, কিন্তু বিপুল প্রতিদান পেল।’

এই হাদিসটি প্রমাণ করে— আল্লাহ তার বান্দাদের অল্প আমলের বিনিময়ে অতি বড় প্রতিদান দেন। হজরত আমর ইবনু সাবিত ইসলামের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করলেন, যদিও তার আমল ছিল অল্প কিন্তু এটাই তাকে জান্নাতের অনন্ত সুখ এনে দিল।

অথচ কখনো একবারও নামাজ পড়ার সুযোগ পাননি কিন্তু আন্তরিক ঈমান, নিঃস্বার্থ জিহাদ ও শহীদ হওয়ার কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জান্নাতি ঘোষণা করেন।

শাইখ ইবনু উসাইমিন বলেন, ‘আল-উসাইরিমের ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়—তিনি পূর্বে ইসলামের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু উহুদের দিনে আল্লাহ তার অন্তরে ঈমান দান করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গে জিহাদে অংশ নেন এবং শহীদ হন। তার শেষ কর্ম ছিল আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ—এটাই তাকে জান্নাতি করেছে।’