ঢাকা শনিবার, ০১ নভেম্বর, ২০২৫

সংকটের আবর্তে ই-ক্যাব

অনিশ্চিত ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যৎ

মো. মোজাম্মেল হক মৃধা
প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৫, ০১:১০ এএম

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ই-কমার্স খাত বর্তমানে এক রূপান্তরকারী শক্তি, যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক সময়ে প্রায় ২৫ শতাংশ। এই খাত লক্ষাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (ঝগঊ) তৈরি করেছে এবং ২০ লাখের বেশি মানুষের জীবিকা এর ওপর নির্ভরশীল। এই দ্রুত বিকাশমান খাতটি যখন শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার মুখাপেক্ষী, ঠিক তখনই এর প্রধান অভিভাবক সংস্থা ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্বহীনতার গভীর সংকটে নিমজ্জিত। কার্যনির্বাহী কমিটির নির্ধারিত নির্বাচন ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই না হওয়া, ৫ আগস্টের পর কার্যনির্বাহী কমিটির পদত্যাগ এবং  মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০২৪-২০২৫ সালজুড়েই নতুন নির্বাচন বারবার স্থগিত হওয়ায় কার্যক্রমে নেমে এসেছে সীমাহীন স্থবিরতা। এই অচলাবস্থা শুধু একটি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা-পরবর্তী (গণঅভ্যুত্থান, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট) সময়ে নীতিগত সহায়তাপ্রাপ্তি, বাজার স্থিতিশীলতা এবং উদ্যোক্তাদের আস্থায় চিড় ধরার মতো বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পুরো ই-কমার্স ইকোসিস্টেমের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি শক্তিশালী ও নির্বাচিত নেতৃত্ব ছাড়া এই খাত কীভাবে এগিয়ে যাবে, সেই প্রশ্নই এখন মুখ্য।
বর্তমান প্রেক্ষাপট: ই-ক্যাবের এই নেতৃত্বশূন্যতা সদস্য, সরকার এবং সমগ্র ই-কমার্স খাতের ওপর এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ই-কমার্স খাতের জরুরি নীতি ও আইন প্রণয়নে ই-ক্যাবের জোরালো ভূমিকা প্রায় অনুপস্থিত। ফলে, খাতটির প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও বিকাশে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ই-ক্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। অনেকেই মনে করছেন, ই-ক্যাব তাদের প্রত্যাশা পূরণে এবং স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। ই-ক্যাবের বাইরেও লক্ষাধিক ই-কমার্স উদ্যোক্তা আছেন। তারা নীতিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ই-ক্যাবের মতো সংগঠনের সাহায্য প্রত্যাশা করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের এই প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না, যা ই-কমার্স ইকোসিস্টেমের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ : ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, কারফিউ 
এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা 
গ্রহণের প্রেক্ষাপটে ই-কমার্স খাতে 
বহুমুখী প্রভাব পড়েছে। 
আন্দোলনকালীন তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক ক্ষতি (পরিসংখ্যানগত তথ্য): ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্ল্যাকআউটের ১৩ দিনে ই-কমার্স খাতে আনুমানিক ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়। এই সময়ে ই-কমার্স খাতে প্রতিদিন ১২০ কোটি টাকারও অধিক ক্ষতি হয়েছে। এফ-কমার্স (ফেসবুক উদ্যোক্তা) খাতে ক্ষতি ৬০০ কোটি টাকারও বেশি, ই-কমার্স খাতে ৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি, ই-লজিস্টিকস খাতে অন্তত ১০০ কোটি টাকা এবং ই-ট্যুরিজম খাতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ফেসবুক-নির্ভর ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হন, পুঁজি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কর্মী ছাঁটাই হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নেতৃত্বহীনতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: ই-ক্যাবের নেতৃত্বশূন্যতার কারণে এই খাতের দাবিগুলো সরকারের কাছে জোরালোভাবে উপস্থাপন করা যায়নি। এই সময়ের ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটেও ই-ক্যাব থেকে কার্যকর পরামর্শ দেওয়া হয়নি। স্বাভাবিক ২৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী খাতটি প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং স্থানীয় উদ্যোক্তা সহায়তার অভাবে তীব্রভাবে ব্যাহত হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে জটিলতা: নির্বাচনের আগে প্রকাশিত ভোটার তালিকা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। বৈধ সদস্য বাদ পড়া এবং ভুয়া ভোটারের নাম অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে। 
ই-ক্যাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের 
নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং আইনি চ্যালেঞ্জের কারণে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ আসায় নির্বাচন প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
বর্তমান সংকটে জরুরি পদক্ষেপ: দুঃখজনক হলেও সত্যি, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ই-ক্যাব প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকায় ই-কমার্স খাতের স্বার্থরক্ষা হচ্ছে না এবং ছোট কোম্পানিগুলো অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী অতিদ্রুত ই-ক্যাবের ফরেনসিক ফাইন্যানশিয়াল অডিট, মেম্বারশিপ অডিট ও মেমোর‌্যান্ডাম অব আর্টিকেলসের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা জরুরি।
সদস্যদের ভূমিকা ও আশু পদক্ষেপ: বর্তমানে প্রশাসকের অধীনে সংগঠন চললেও সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। সদস্যরা তাদের সমস্যা ও প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করে প্রশাসকের কাছে খাতের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে পারে। বিভিন্ন সদস্য প্রতিষ্ঠান সম্মিলিত ফোরাম গঠন করে তা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে পারে, এতে দাবিগুলো আরও শক্তিশালী হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে এবং দ্রুত বৈধ ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য সদস্যরা প্রশাসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। একই সঙ্গে, বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ২০২৫ অনুযায়ী সংঘ বিধির আধুনিকীকরণেও তারা ভূমিকা রাখতে পারে।
ই-ক্যাবের ভবিষ্যৎ : ই-ক্যাবের নেতৃত্বের সংকট পুরো খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তবে উত্তরণের পথ আছে। ই-ক্যাবের কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনতে একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের বিকল্প নেই। বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ২০২৫ অনুযায়ী সংঘ বিধির আধুনিকীকরণ করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা হলে নতুন নেতৃত্ব এই সংগঠনকে গতিশীল করতে পারবে। ই-ক্যাবকে কেবল বড় প্রতিষ্ঠানের সংগঠন না হয়ে, লাখ লাখ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে।