ভোটের হিসাব-নিকাশ যত এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য ততই তীব্র হচ্ছে। নির্বাচনের রোডম্যাপের প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের আস্থাহীনতাও তৈরি হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপি।
এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মনে করে সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্কার করে নির্বাচন দিতে পারে সরকার তবে, সেটি ডিসেম্বরই হতে হবে এটি যৌক্তিক নয়। এটি ডিসেম্বরের দুই মাস পরেও হতে পারে, তবে তার জন্য রোডম্যাপ দেওয়া অনেক বেশি জরুরি।
ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে দীর্ঘদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যারা রাজপথে শামিল ছিলেন, নির্বাচনের বিষয়ে আট মাসের মাথায় এসে তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে মতানৈক্য।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কদের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যসহ বিরোধ স্পষ্ট। স্বৈরাচার হাসিনাবিরোধী ১৫ বছরের আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলের অবদান ও ত্যাগ রয়েছে। তবে, নির্বাচনের সময় নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার ইস্যুর সমাধান না হতেই এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন।
এদিকে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে বলে সাফ জানিয়েছে বিএনপি। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো বলছে রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম উপাদন হলো নির্বাচন। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে পরিবর্তনের স্বপ্ন জনগণ দেখছে, তা পূরণ হবে না।
রোডম্যাপ প্রদান ও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা এমন একটি নির্বাচন চাই, যা রাজনৈতিকভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। সেজন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন সেটুকু করে নির্বাচন দেওয়া উচিত। তার জন্য ৯ মাস যথেষ্ট সময়, সরকার চাইলে এ সময়ের মধ্যেই নির্বাচন দিতে পারত। তবে, নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরই হতে হবে, ফেব্রুয়ারি বা মার্চে হতে পারবে না এমন নয়। অনেক সময় কিছু বিশেষ কাজের জন্য এক বা দুই মাস দেরি হতে পারে, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা সরকারকে কোনো সময় বেঁধে দেইনি, বরং নির্দিষ্ট সময় চেয়েছি। যে বড় দলটি ডিসেম্বরে সময় বেঁধে দিয়েছে, তাদের কথা সরকার কতটা শুনবে সেটা সময় বলে দেবে, না মানলে তারা কী করবেন সেটাও দেখার বিষয়।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। সংস্কারের রূপরেখা দিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচন করা প্রয়োজন। সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করে বাংলাদেশে একটা যথাযথ নির্বাচনি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। তবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নির্বাচনের জন্য যেসব ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়েই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা দরকার। এরপরে যত শিগগির সম্ভব নির্বাচন আয়োজন করা দরকার। এমন একটি ব্যবস্থা করা উচিত, যে ব্যবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও সঠিক হবে। এটার জন্য যা যা করা দরকার, যদি শক্ত হতে হয় তাহলে শক্ত হতে হবে। কারণ নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণসহ নানা ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হয়েছে। এ পরিবর্তনের পর প্রথম কর্তব্য একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। সে কারণে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন না, জাতীয় নির্বাচন-এমন বিতর্ক উত্থাপন করে পরিস্থিতিটা ঘোলা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগেই সম্পন্ন করা উচিত এবং এ বছরের ভেতরেই তা সম্পন্ন করা উচিত।
গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। গণহত্যার মূল আসামিরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম উপাদন হলো নির্বাচন। দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন তিনটি আলাপ একই সঙ্গে হতে হবে। গণহত্যার বিচারে গত আট মাসেও প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি। এখন পর্যন্ত সরকার নির্বাচন নিয়ে কোনো রোডম্যাপ প্রকাশ করতে পারেনি।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার অবিলম্বে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দিলে প্রয়োজনে রাজপথে নামতে পারে বিএনপি। গত দুই দিনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির সিনিয়র নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসা বিএনপি নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা করছে।
জানা যায়, নির্বাচন ঠিক কবে হবে কিংবা সরকার নিজেদের দেওয়া রোডম্যাপের ধারণার মধ্যে নির্বাচন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে দলটির মধ্যে উৎকণ্ঠা ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও আরও কিছু দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলটির প্রত্যাশা, সরকার অচিরেই রোডম্যাপের ব্যাপারটি স্পষ্ট করবে। না হলে ঈদুল আজহার পরে যুগপতের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারে। তখন ওই পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী হবে বলে মনে করে বিএনপি।