হ্যাকের ঘটনার পর প্রায় দুই মাস পার হলেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সার্ভারটি এখনো চালু হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকার কারণে থমকে দাঁড়িয়েছে সব ধরনের সেবা। ফলে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি সরকার কম করে হলেও শতকোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রÑ কোনো কিছুই হচ্ছে না। এমনকি সাধারণ তথ্যও মিলছে না। এ অবস্থায় গোটা রাজউক বর্তমানে সেবাহীন এক অকার্যকর সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
গত ১৯ মে সংস্থাটির সার্ভার হ্যাকারদের কবলে পড়ে। এরপর থেকেই সার্ভারটি বন্ধ করে দিয়ে তারা তদন্ত এবং আইনি পদক্ষেপের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তদন্তে ঘটনার নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত করতে না পারলেও দূরবর্তী কিছু লোকদের নিয়ে বেশ মাতামাতি শুরু হয়। এদিকে তাদের দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তারদের নিয়েও নানা প্রশ্ন সামনে আসে।
বলাবলি হচ্ছে, মূল অপরাধীরা সবক্ষেত্রেই আড়াল হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সংস্থার সেবাধর্মী কাজ-কর্মে যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, সেদিকে তাদের বিন্দুমাত্রও ভ্রƒক্ষেপ নেই। ফলে সার্ভার হ্যাকের বিষয়টি ক্রমান্বয়ে রহস্যাবৃত হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, একটি সার্ভার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে এত সময়ক্ষেপণ হতে পারে না। এটি পুনরায় চালু করতে ১৫ দিনের বেশি লাগার কথা নয়। তাহলে এত দীর্ঘ সময় ধরে রাজউক এবং ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান দোহা টেকÑ কী করছে এমন প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
এ নিয়ে রূপালী বাংলাদেশ দোহা টেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হুদার কাছে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, এটি রাজউকের বিষয়Ñ তাদের সাথে কথা বলুন। আমাদের কিছু বলার নেই।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বললেন, আমি কিছুই জানি না। আপনি সিস্টেম এনালিস্ট কাজী মাহবুবুল হকের সঙ্গে কথা বলুন।
রূপালী বাংলাদেশ কাজী মাহবুবের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি জানান, চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া কথা বলা যাবে না। রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করা হলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সার্ভার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত দোহা টেকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। শিগগিরই নতুন প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হবে।
সার্ভারের নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কম্পিউটার কাউন্সিলকে অনুরোধ করেছি এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধান দেওয়ার জন্য। তাদের মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হ্যাকের কারণে সার্ভার বন্ধ থাকায় সংস্থার সেবা কার্যক্রম বন্ধ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, জোরেশোরে কাজ চলছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে এমনকি আগামী সপ্তাহেই সার্ভার চালু করা হতে পারে।
কেন বারবার সার্ভার হ্যাক হয়: রাজউকের সার্ভার দুই বছরের মাথায় গত ১৯ মে দ্বিতীয়বারের মতো হ্যাক হয়। ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর এটি প্রথম হ্যাকারকবলিত হয়। টানা ১৭ দিন পর ২১ ডিসেম্বর সার্ভারটি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর রাজউক দেখতে পায়, সার্ভারে ৩০ হাজার ফাইলের কোনো অস্তিত্ব নেই। যেসব গ্রাহকের নথিপত্র হারিয়ে গেছে, তারা ২০১৯ সালের মে মাস থেকে ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমোদন পেতে আবেদন করেছিলেন। বিষয়টি শেষমেশ উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বিজ্ঞ হাইকোর্টের বিচারপতি নজরুল ইসলাম ও বিচারপতি খিজির হায়াতের দ্বৈত বেঞ্চ দীর্ঘ শুনানি শেষে ৩০ হাজার নথি গায়েবের বিষয়ে ৩০ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চান তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে। তখন রাজউক চেয়ারম্যান ছিলেন আনিসুর রহমান মিঞা। সেই সময় রাজউকের কাছে হার্ডডিস্ক থাকার দাবি করা হলেও গ্রাহকরা তাদের নথি ফিরে পেয়েছেন শোনা যায়নি। যদিও সাইবার বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী হার্ডডিস্ক থাকলে স্ক্যান করে নথিপত্র ফেরত দেওয়া সম্ভব। প্রথমবার যখন সার্ভারটি হ্যাকারকবলিত হয়, তখন এটির ব্যবস্থাপনায় ছিল টেকনোহ্যাভেন লি. নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অনলাইন সেবার পাশাপাশি সার্ভার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও প্রতিষ্ঠানটির ওপর অর্পিত ছিল। এ ছাড়া সার্ভার হ্যাক হওয়ার পর তথ্য পুনরুদ্ধারের কাজটিও এই কোম্পানি করেছে। বিশেষভাবে রাজউকের অনলাইন সেবার জন্য একটি ওয়েবসাইটে সহযোগিতা দেওয়াও ছিল তাদের চুক্তির আওতায়। কিন্তু সার্ভার পুনরুদ্ধার ছাড়া আর কোনো দায়িত্বই তারা সুচারুরূপে পালন করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যদি কোনো কারণে তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না হয়, তবে রাজউকের সংগৃহীত হার্ডকপি থেকে তথ্য আপলোড করা যেত। তারা এজন্য ডাটাগুলোর সঠিক ব্যাকআপ না রাখাকেই দায়ী করেন।
গত ১৯ মে দ্বিতীয়বার হ্যাকের ঘটনা সম্পর্কে বঙ্গ সফট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন বলেন, বেসিক সিকিউরিটি দুর্বল হলে দুর্বৃত্তরা সহজেই কম্প্রোমাইজ করে ফেলে। আমার মনে হয়, এই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সার্ভার অ্যাটাক হলে তাদের করণীয় সম্পর্কে আগেভাগেই ঠিক করে রাখা উচিত ছিল। তাই এই হ্যাকের দায় তারা এড়াতে পারে না বলে তিনি মনে করেন।
আব্দুল বাতেন আরও বলেন, ব্যাকআপের পাশাপাশি সার্ভারের নিয়মিত মনিটরিং একটি প্রধানতম দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব তারা কতটুকু পালন করেছেন সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। তিনি বলেন, দিনে দিনে প্রযুক্তি পরিবর্তিত হয়। পুরোনো প্রযুুক্তি থাকলে তা বদলানো জরুরি।
সার্ভার পুনরুদ্ধারে সময়ক্ষেপণ সম্পর্কে আব্দুল বাতেনের অভিমত, প্রয়োজনীয় ব্যাকআপ থাকলে তা এক-দুই ঘণ্টার মধ্যেই চালু করা সম্ভব। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক সপ্তাহও লেগে যেতে পারে, কিন্তু দু’মাস তো প্রশ্নই উঠে না।
তিনি বলেন, সময় পাল্টে গেছে, আমরা এখন সেকেন্ড-মিনিট কাউন্ট করছি। অল্প খরচে তিন স্তরের ব্যাকআপ গড়ে তোলা মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। সুতরাং ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান দোহা টেক এই দায় থেকেও মুক্তি পেতে পারে না।
আব্দুল বাতেন রাজউকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সার্ভার হ্যাক এবং পুনরুদ্ধারে সময়ক্ষেপণ সমর্থনযোগ্য নয় বলে মতামত ব্যক্ত করেন। সেই সঙ্গে তিনি হ্যাকারদের সঙ্গে রাজউকের সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশের বিষয়টিও জোর দিয়ে উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান দোহা টেককে মনোনয়নের পেছনে অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। তবে এই অভিযোগ সম্পর্কে রাজউক সংশ্লিষ্টরা মুখ খুলতে নারাজ। প্রাথমিকভাবে ২০১৬ সালে আট অঞ্চলের মধ্যে শুধু অঞ্চল ৫-এ ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র দেওয়ার মাধ্যমে রাজউকের অনলাইন কার্যক্রমের সূচনা।
সব অঞ্চলে অনলাইনে ভূমি ব্যবহারে ছাড়পত্র দেওয়া শুরু হয় ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালের মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের পাশাপাশি নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার কাজটিও শুরু করে রাজউক। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে অনলাইনেই রাজউকের সব সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে এর সঠিক পরিচর্যা এবং তদারকির বিষয়টি ছিল বরাবরই উপেক্ষিত।
আপনার মতামত লিখুন :