ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান কারাবন্দি নেতা আমির হোসেন আমু। তার ঢাকার ইস্কাটনের বাসায় কম্পিউটার অপারেটর বা কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন আরিফুল ইসলাম শাওন (৩৫)। পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সূর্যপাশা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মো. ফিরোজ আলমের ছেলে শাওন একসময় নলছিটিতে মোবাইল মেকানিকের কাজ করতেন।
নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা এই যুবক সাবেক মন্ত্রী আমুর ছত্রছায়ায় মাত্র এক যুগে বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। নলছিটি-ঝালকাঠি ছাড়াও ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট কিনে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন শাওন। আওয়ামী লীগের পতনের কয়েক মাস পর গ্রেপ্তার হলেও এখনো নলছিটি শহরে প্রায় ১০ কোটি টাকার সড়ক-ব্রিজ নির্মাণে তার ঠিকাদারি কাজ চলছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এলাকাবাসীর দাবি, আমুর বাসার এই সামান্য কর্মচারীর বিপুল অবৈধ সম্পদের উৎস সম্পর্কে দুদক অনুসন্ধান চালালে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
এদিকে গত রোববার নলছিটির আলোচিত ইমরান হত্যা মামলায় শাওনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন।
নলছিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস সালাম জানান, ইমরান হত্যা মামলায় তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে পাঠানো হবে। প্রয়োজনে ফের শাওনকে রিমান্ডে আনা হবে। এর আগে গত ১৩ মে ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা এলাকার একটি বাসা থেকে আরিফুল ইসলাম শাওনকে গ্রেপ্তার করে কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ। তারপর থেকেই তিনি কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
জানা যায়, ২০১২ সালে জেলা ছাত্রলীগের এক নেতার মাধ্যমে আমির হোসেন আমুর বাসায় কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেন। আমুর বিশেষ সহকারী ফকরুল মজিদ কিরণ কম্পিউটার ব্যবহার করতে না পারায় শাওন তার কাজে সহায়তা করতেন। সেখান থেকেই তার আলাদিনের চেরাগ পাওয়া। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাই জানান, দলীয় প্রভাব, ক্ষমতা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন শাওন। কমিশন বাণিজ্য, ভোট নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার ভাগবাঁটোয়ারা, টিআর-কাবিখা, টিউবওয়েল বরাদ্দ, চাকরি বদলিÑ সব জায়গায় ছিল তার প্রভাব। পার্সেন্টেজ না দিলে কোনো কাজ হতো না বলে অভিযোগ রয়েছে।
তারা আরও জানান, ছোট ভাই মুকুল খান চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি পান শাওনের সুপারিশে। পৌরসভা থেকে শুরু করে প্রশাসনÑ সবকিছুই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। রাজসিক জীবনযাপন করতেন, ব্যবহার করতেন একাধিক গাড়ি। এই সবকিছু সম্ভব হয়েছিল শুধু আমু এমপির ‘বিশ্বস্ত স্টাফ’ থাকার সুবাদে। শাওনের কারণে তার বাবা পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং পৌরসভার বিভিন্ন দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতেও তিনি ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর শাওন আত্মগোপনে চলে যান। সেদিন বিকেলেই আমু এমপির ইস্কাটনের বাসা থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা, বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে তিনি লাপাত্তা হন। তবে কয়েক মাস পালিয়ে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। গত ১৩ মে রাজধানীর শুভাঢ্যা এলাকার একটি বাসা থেকে কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ তাকে আটক করে। তারপর থেকেই তিনি জেলা কারাগারে বন্দি ছিলেন।
হত্যা মামলায় রিমান্ডে: পুলিশ জানায়, ২০২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নলছিটি পৌরসভার নান্দিকাঠি এলাকায় ইমরান হোসেন (৩২) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনি ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল সমিতির সভাপতি ও উপজেলা শ্রমিক লীগের কর্মী ছিলেন। নিহত ইমরান উপজেলার খাজুরিয়া এলাকার আবদুর রশিদের ছেলে।
এ ঘটনায় ইমরানের পিতা আবদুর রশিদ হাওলাদার খাজুরিয়া এলাকার ইদ্রিস হাওলাদারের পুত্র আল-আমিনকে প্রধান আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্তে উঠে আসে এই হত্যাকা-ে আরিফুল ইসলাম শাওনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি।
পরে মামলার অন্যতম আসামি বরগুনার আমতলী উপজেলার সেলিম মাতবরকে ঢাকার ডেমরা থানার পুলিশ আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম স্বীকার করেন, শাওন তাকে ভাড়াটে খুনি হিসেবে খুনের জন্য নিয়োগ দেন। এই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ কারাবন্দি শাওনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলে। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে মামলার তদন্ত কর্মাকর্তা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নলছিটি থানায় নিয়ে আসেন। তার বাবা মো. ফিরোজ আলম নলছিটি উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি এবং তিনিও একটি মামলায় কারাবন্দি রয়েছেন।