নদীটির নাম খাপড়াভাঙ্গা। শিববাড়িয়া নদী নামেও এর আছে পরিচিত। কলকল স্রোতে বয়ে যাওয়া নদীটির দুই প্রান্ত সাগরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কারণে ‘খাপড়াভাঙ্গা দোন’ বলা হয়। নদীটির পশ্চিম প্রান্তে আন্ধারমানিক মোহনা আর পূর্ব প্রান্ত মিলিত হয়েছে রামনাবাদ মোহনায়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় সমুদ্রে মাছ ধরা ট্রলারগুলো দ্রুত নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে বিধায় পোতাশ্রয় নদী নামেও খ্যাতি আছে। নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে আশাখালী মৎস্যপল্লি, চাপলী বাজার, লক্ষ্মীরহাট ও আলীপুর-মহিপুর মৎস্যবন্দর। এসব বন্দরের মৎস্য ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত পলিথিন ও প্লাস্টিক ফেলা হচ্ছে নদীতে। নদীর পেটের এসব প্লাস্টিক ও পলিথিন ভাটার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। ধীরে ধীরে ছোট ছোট মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়ে খাদ্য ও পানির মাধ্যমে জলজ প্রাণী গ্রহণ করে। এতে ধ্বংস হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, কমছে মাছের উৎপাদন। পরিবেশ নষ্টের অন্যতম কারণ এসব প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগকে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানায় অবস্থিত খাপড়াভাঙ্গা নদীটি। এটি আকারে ছোট্ট হলেও এই উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে দীর্ঘ বছর ধরে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অসচেতনতার কারণে দখল-দূষণে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে নদীটি। প্রতিনিয়ত নির্বিচারে মৎস্যবন্দরে ব্যবহৃত পলিথিন ও প্লাস্টিকসামগ্রী ফেলা হচ্ছে নদীর পাড়ে। বিকল্প না পেয়ে ব্যবসায়ীরা পলিথিন ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর মৎস্যবন্দরের বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা না থাকার অজুহাতে ফেলা হচ্ছে নদীতে। অথচ আলীপুর, মহিপুর মৎস্যবন্দর থেকে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে। ব্যবসায়ীদের জন্য শুধু দুপাড়ে দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। আলীপুরের অবতরণকেন্দ্রটি ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করলেও মহিপুরেরটি ব্যবহার করছেন না। ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে বারবার বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু আশ্বাস দিয়ে সময়ক্ষেপণ করেছেন মৎস্য অধিদপ্তর।
এ প্রসঙ্গে আলীপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা পলিথিন ফেলার জন্য বিএফডিসি কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার জায়গা চেয়েছি। তারা কোনো জায়গা নির্ধারণ করে দেয়নি। তাই বিভিন্ন সময় জেলেরা যে পলিথিনগুলো ফেলে দেয়, তা নদীর পানির সঙ্গে মিশে যায়।’
পরিবেশদূষণ রোধ, মাটির উর্বরতা রক্ষা, পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ কমানো, ডেঙ্গু ও অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী মশা নির্মূল করা এবং মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালের ১ মার্চ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের (সংশোধনী) মাধ্যমে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু আইনটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ না করায় পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া মাছ সংরক্ষণ ও রপ্তানির জন্য পলিথিনের বিকল্প নেই ব্যবসায়ীদের কাছে। মাছে বরফ দেওয়ার জন্য পাট বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, একই দামে পলিথিনের বিকল্প পেলে তারা ব্যবহার করবেন।
এ বিষয়ে মৎস্য ব্যবসায়ী এম আনিসুর রহমান মামুন বলেন, ‘আমাদের আহরিত মাছগুলো পলিতে প্যাকেট করলে ভালো থাকে। এর বিকল্প যে ব্যাগ আছে, তা মাছ প্যাকেট করার উপযোগী না। মাছ সংরক্ষণের জন্য পলিথিনের বিকল্প কিছু এলে আমরা অবশ্যই ব্যবহার করব।’
পলিথিন অপচনশীল হওয়ায় কয়েকশ বছর পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। ফলে নদী ও সমুদ্রের পানিতে মিশে জলজ প্রাণীর জীবনহানি ঘটায়, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে। সামুদ্রিক পরিবেশ দূষিত করে। গবেষণার তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন সমুদ্রে ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ছে। এতে ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য রয়েছে। এর মধ্যে কোমল পানীয়র বোতল থেকে শুরু করে কসমেটিকসের মোড়ক রয়েছে। প্লাস্টিক বোতলের একটি বড় অংশ যাচ্ছে উপকূলের মাছ ধরা ট্রলারে।
পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক নাগরিক সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’ কলাপাড়া উপজেলা সমন্বয়কারী ও সিনিয়র সাংবাদিক মেজবাহউদ্দিন মাননু বলেন, ‘উপকূলের মৎস্যবন্দর ব্যবসায়ী ও জেলেদের সচেতন করতে হবে। শুধু বিশ্ব পরিবেশ দিবসে একটি র্যালি ও আলোচনা সভার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। উপজেলা পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটিকে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন রাখতে হবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও পুনর্ব্যবহারের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিকদূষণ রোধে সরকার, উৎপাদক, ব্যবহারকারী ও পরিবেশবাদীদের সম্মিলিতভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেফাস প্রজেক্টের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, ‘পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে নদী ও সমুদ্রদূষণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তরকে সম্মিলিতভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক দপ্তর অন্য দপ্তরের ওপর দায় চাপিয়ে নিশ্চুপ থাকলে আমাদের সামুদ্রিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ দিনে দিনে নষ্ট হবে। আমাদের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মৎস্যজীবীদের আরও বেশি সচেতন করতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মহিপুর-আলীপুর ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী খাপড়াভাঙ্গা নদীতে ফেলা হচ্ছে। এটা আমাদের জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বহুবার বন্দরের ব্যবসায়ীদের সচেতন করা হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর জলজ প্রাণী রক্ষা ও নদীদূষণ রোধে যথেষ্ট সচেতন রয়েছে। দ্রুত বন্দর ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা করে তাদের ব্যবহৃত পলিথিন নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।