- আপন ভাতিজাকে পিএস হিসেবে নিয়োগ প্রদান
- সিগারেটের বিল ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা
দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, কর্মকর্তাদের নিজ প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি ব্যবসা করা, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসরদের পুনর্বাসন ও স্বজনপ্রীতির আরেক নাম এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)। দেশের একমাত্র সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের অবৈধ আর্থিক লেনদেন, টেন্ডার বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, নি¤œমানের ওষুধ উৎপাদন এবং অর্থ লোপাটের মতো গুরুতর অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটিকে আরও বিতর্কিত করেছে। এ ছাড়া নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এ সামাদ মৃধার বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, বিগত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে ২ অক্টোবর ইস্তফা দেন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা এহসানুল কবির। এরপর ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকা থেকে দেশে এসে যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী দ্বৈত নাগরিক মো. এ সামাদ মৃধাকে বসানো হয় ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে, যিনি ৫ আগস্টের পর হঠাৎ করে বনে যান বিএনপির রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। মো. এ সামাদ মৃধা ইডিসিএলের এমডি হিসেবে যোগদানের পর এখন নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা ট্রেজারার হিসেবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশ ফ্যাসিস্ট-মুক্ত হলেও এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে এখনো চলছে ফ্যাসিস্টপন্থিদের আধিপত্য। এ ছাড়া গত কয়েক মাস ধরেই প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে ছাঁটাইয়ের মহোৎসব। ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এ সামাদ মৃধার ছত্রছায়ায় এ পর্যন্ত ছাঁটাই করা হয়েছে ৭২২ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। কারণ ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এ সামাদ মৃধার আপন ভাতিজা নাজমুল হুদার মাধ্যমেই চলছে এসব অপকর্ম। ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে মো. এ সামাদ মৃধা যোগ দেওয়ার চার দিনের মাথায় কোনো প্রকার নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে নিজ ক্ষমতাবলে আপন ভাতিজা নাজমুল হুদাকে সিনিয়র অফিসার ও ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। এরপর পুনরায় তিন দিনের মাথায় তাকে ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি প্রদান করেন।
বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় নাজমুল হুদা ছিলেন প্রভাবশালী সাংসদ নিক্সন চৌধুরীর ডান হাত। এ ছাড়া জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে। ইডিসিএলে কর্মরত এক কর্মচারী জানান, প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন নারী কর্মীর সঙ্গে সামাদ মৃধার সখ্য গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রে তিনি নিয়মের বাইরে গিয়ে কয়েকজনকে প্রমোশনও দিয়েছেন। নিয়োগের পর মাসখানেকের মধ্য এমডি সেকশনে আনা হয় এক সিনিয়র ক্লার্ককে।
এর কিছুদিনের মধ্যেই তাকে দুটি প্রমোশন দিয়ে জুনিয়র অফিসার বানিয়েছেন এমডি। ইডিসিএলের অনেকেই তাকে এমডির প্রিয়ভাজন হিসেবে জানেন। আর এই নারীর কিছু গোপন ভিডিও এখন প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের মুঠোফোনে এসেছে, যা নিয়ে চলছে কানাঘুষা। এদিকে আরেক নারী উৎপাদন কর্মকর্তাকে এক মাস আগে ব্যাকডেট দেখিয়ে প্রমোশন দেওয়া হয়, যা নিয়ে বিতর্ক চলছে ইডিসিএল ঢাকা প্ল্যান্টে। এদিকে ইডিসিএল এমডির এমন কেলেঙ্কারির বিষয়টি সামনে আসায় প্রতিষ্ঠানের অন্যদের যৌন হয়রানি নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সূত্রটি আরও জানায়, শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মো. আমিনুল ইসলাম রুবেল বিগত ১৫ বছর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ছেলেকে ব্যাবসায়িক পার্টনার বানিয়ে পুরো এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেডের সব টেন্ডার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সব ওষুধ সরবরাহ করেন। বর্তমান এমডি মো. এ সামাদ মৃধা যোগদানের পর থেকে আওয়ামী লীগ নেতা মো. আমিনুল ইসলাম রুবেল এমডির ভাতিজা নাজমুল হুদা, প্রোডাক্টশন মহাব্যবস্থাপক মো. নজরুল ইসলাম ও পার্চেজ ম্যানেজার মো. নজরুল ইসলাম সরকারকে মেসার্স মার্ক করপোরেশন, আর কে ট্রেডার্স ও সানবিন ইন্টারন্যাশনাল নামে তার এই তিন কোম্পানির পার্টনার বানিয়ে একচেটিয়াভাবে ইডিসিএলের সব ওষুধ সরবরাহসহ নানা ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছে। মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখরের মদতপুষ্ট হয়ে ইডিসিএলে নিয়োগ পান মনিরুল।
একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির ম্যানেজার থেকে সরাসরি খুলনা এসেনসিয়াল ল্যাটেক্স প্লান্টের (কেইএলপি) ডিজিএম পদে আসীন হন। এরপর সেখানে গড়ে তোলেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০২২ সালে নারীঘটিত এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বগুড়া প্লান্টে বদলি করা হয়। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইডিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এহসানুল কবির জগলুলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ঢাকা হেড অফিসে পার্চেজ কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। পরে ইডিসিএলের বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায়িত্বে এলে মনিরুলের কপাল খুলে যায়। সরাসরি প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) পদ জুটিয়ে নেন তিনি।
এর পরই তিনি অতিরিক্ত জনবলের দোহাই দিয়ে চাকরিচ্যুত করার কাজে নামেন। ইডিসিএলের ঢাকা প্ল্যান্টে গত ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ১২৫ জন ক্যাজুয়াল কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ৩৭ জনকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর পুরো আর্থিক লেনদেনই হয় গোপনে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রোডাকশন মহাব্যবস্থাপক মো. নজরুল ইসলাম, পার্চেজ ম্যানেজার মো. নজরুল ইসলাম সরকার ও এমডির আত্মীয় শওকত। এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্ষমতাধর ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এ সামাদ মৃধার ভাতিজা পিএস নাজমুল হুদা নিজেই।
সূত্রটি আরও জানায়, ১৯৮৩ সালে এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে সরকার। ঢাকায় প্রধান কারখানা ছাড়াও খুলনা এসেনসিয়াল ল্যাটেক্স প্ল্যান্ট (কেইএলপি) হলো ইডিসিএলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন ইউনিট। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য মানসম্পন্ন পুরুষ কনডম উৎপাদন হয় এখানে। এ ছাড়া বগুড়ায় ইডিসিএলের আরেকটি বৃহৎ উৎপাদনকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে সেফালোস্পোরিন প্রকল্পের অধীনে আধুনিক ওষুধ উৎপাদনের সুবিধা রয়েছে। গোপালগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে রয়েছে এসেনসিয়াাল ড্রাগসের প্ল্যান্ট।
এদিকে খুলনার সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলনা এসেন্সিয়াল ল্যাটেক্স প্ল্যান্টে ২০২৫ সালের বার্ষিক বনভোজন উপলক্ষে ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭০ টাকার বাজেট বরাদ্দ হলেও বাস্তবে তার সিংহভাগই দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। বনভোজনের সমস্ত খরচ এককভাবে তোলা হয় উপপ্রশাসনিক কর্মকর্তা শাপলা খাতুনের নামে। আরও বিস্ময়ের বিষয় হলোÑ সব ভাউচার ও খরচপত্র এক ব্যক্তির হাতে লেখা, যেখানে মাছ, মাংস, ফলমূল থেকে শুরু করে পোশাক কেনা পর্যন্ত একই হাতের লেখায় প্রস্তুতকৃত মেমো পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সামাদ মৃধা প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিলেও তার সঙ্গে বিশেষ অতিথি ছিলেন আলোচিত এক মডেল।
আপ্যায়নের নামে ৪০ কেজি খাসির কলিজা, ৪০ কেজি আপেলের জুস, আধা মণ আঙুর এবং ২৬৪ কেজি মাছ, যার মধ্যে ৬০ কেজি রূপচাঁদা, ১১৫ কেজি চিংড়ি, ৩৬ কেজি বোয়াল ইত্যাদির বিল দেখানো হয়। মাছের জন্যই ব্যয় ধরা হয় ৪ লাখ ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাছ খেতেই পাননি। ১৬০ কেজি আপেল বিতরণ করা হলেও ১৫০ কেজি কমলা শুধু বিলেই ছিল। ৪ হাজার পিস ২ টাকার চকলেটের বিল করা হয়েছে ১০ টাকা দরে।
সোনালি মুরগির রোস্ট থাকলেও ২০০ কেজি ব্রয়লার মুরগির বিল দেখানো হয় ৪২ হাজার টাকার। ৮৮১ জনের বনভোজনে ৩০০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ও ১৫০ জন ক্যাটারিং প্রত্যেককে উপহার দেওয়া হয় ভিআইপি বেডশিট, যার দাম দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত। অথচ প্রকৃত দাম ছিল ৪৫০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে। ৫০০ এমএল পানির বোতলের বদলে ২৫০ এমএল সরবরাহ করে ৫ হাজার ২০০ বোতলের বিল করা হয়। সিগারেটের বিল দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা; যার সিংহভাগ উঠেছে সিবিএ নেতা কামাল ও তার সহযোগী আল-আমিনের পকেটে।
আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে হিসাব বিভাগের প্রধান কাজী তানজিমা তাবাচ্ছুম বলেন, ‘যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, তারা মিথ্যা বলছে। সাধারণত চাকরিচ্যুত ব্যক্তিরা ইমান হারিয়ে ফেলেন, তাই মিথ্যা কথা বলে থাকেন। ইডিসিএলে আর্থিক অনিয়ম এতটাই তুঙ্গে যে, এখানে একই পরিবারের ডজন ডজন লোক কাজ করছেন বিশেষ সুপারিশে, তার বড় উদাহরণ হাসান ইমাম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার পরিবার ও আত্মীয়-অনাত্মীয় মিলে এখানে প্রায় ৫০ জন লোক কাজ করছে। এর মধ্যে তার আপন তিন বোন ঢাকা, গোপালগঞ্জ ও খুলনা প্ল্যান্টে কমর্রত। অভিযোগের বিষয়ে সামাদ মৃধা বলেন, ‘নেংটা ভিডিও করছি কি হইছে? প্রয়োজনে জিরো পয়েন্টে বড় স্ক্রিন লাগিয়ে চালাব, দেখি কে কী করে। এসব বলে লাভ নাই, চাকরি না থাকলে আবার বিদেশে চলে যাব।’