সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ১২:৩০ এএম

রাখাইন জুড়ে আরাকানের পতাকা - বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি আরাকান আর্মির

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ১২:৩০ এএম

রাখাইন জুড়ে আরাকানের পতাকা - বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি আরাকান আর্মির

মিয়ানমারের রাখাইনের রাজধানী সিত্তে দখলে নজর আরাকান আর্মির। সিত্তের পাশাপাশি ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর প্রকল্প এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা তেল ও গ্যাস পাইপলাইন এবং গভীর সমুদ্রবন্দর কিয়াউকপিউ দখল করতে চাইছে বিদ্রোহী দলটি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আরাকান আর্মি এখন চূড়ান্ত আক্রমণ চালানোর অপেক্ষায়।

পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে আরাকান আর্মি (এএ) যত কাছাকাছি আসছে, রাখাইন রাজ্য ততই গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মুখোমুখি হচ্ছে। এই ক্ষমতা পরিবর্তন দেশটির গৃহযুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি উভয়কেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার দেশের অন্য এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ অনেকটা ফিরে পেলেও রাখাইনের চিত্র ভিন্ন। আরাকান আর্মি এখন রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৪টিই নিয়ন্ত্রণ করছে।

বঙ্গোপসাগরের পাড়ের বাংলাদেশ লাগোয়া এই রাজ্যের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। এর সঙ্গে আঞ্চলিক নানা স্বার্থও জড়িত। তবে রাখাইনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোষ্ঠীটির গুরুতর নির্যাতনের অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অবরোধের কারণে রাখাইনে মানবিক সংকট বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের ধারণা, সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে।

চলতি মাসের শুরুতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (এফএও) সতর্ক করেছিল, মধ্য রাখাইনে ৫৭ শতাংশ পরিবার তাদের মৌলিক খাদ্যচাহিদা মেটাতে পারছে না, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৩৩ শতাংশ। সিত্তের অবরুদ্ধ এলাকায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ আটকে পড়েছে, যেখানে এখন সাগর ও আকাশপথ ছাড়া যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সিত্তের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সেখানে নিত্যপণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। যে শূকরের মাংসের দাম একসময় ২ ডলার ছিল, তা এখন ১৩ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ায় হতাশ মানুষ আত্মহত্যা করছে, ভিক্ষাবৃত্তিতে ঝুঁকছে, যৌনকর্ম বাড়ছে এবং দিনের বেলায়ও চুরি হচ্ছে। সম্প্রতি সিত্তে ছেড়ে আসা এক ব্যক্তি বলেন, ‘দিনের বেলায়ও বাড়িঘরে ঢুকে তারা সবকিছু নিয়ে যায়।’
সিত্তেতে থাকা এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী স্থানীয় জনগণের কথোপকথন পর্যবেক্ষণ করে। যখন সৈন্যরা বাড়িগুলোতে অভিযান চালায়, তখন দেখে বাসিন্দাদের শরীরে আরকান আর্মির ট্যাটু আছে কি না।

আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) একজন প্রতিনিধি সিত্তেকে সামরিক শাসনের একটি কঠোর উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলেন, দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী আরাকান বা রাখাইনকে দখলকৃত ভূখ- হিসেবেই বিবেচনা করে আসছে।

বেসামরিক মৃত্যু বাড়ছেই: আরাকান আর্মিকে ঠেকাতে বিমান হামলা চালাচ্ছে সামরিক বাহিনী। ২০২১ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সারা দেশেই এই কৌশল ব্যবহার করছে জেনারেলরা। ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) দাবি করছে, ২০২৩ সালের শেষের দিক থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিমান হামলায় ৪০২ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৯৬ জন শিশু। তারা আরও জানায়, এ বছর গোলাবর্ষণ, স্থলমাইন বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ে আরও ২৬ জন বেসামরিক লোক মারা গেছে। ইউএলএর একজন প্রতিনিধি বলেন, বেসামরিক মানুষের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে কোনো ফল আসবে না।

বরং একে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলা যায়। সংঘাত বাড়তে থাকায় আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী উভয়েই তাদের বাহিনীকে শক্তিশালী করতে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেছে।

‘জাতীয় মুক্তি’র লক্ষ্যে চালানো লড়াই বেগমান করতে আরাকান আর্মি মে মাস থেকে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সি পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সি নারীদের দলভুক্ত করছে। অন্যদিকে সামরিক বাহিনী আনুমানিক ৭০ হাজার পুরুষকে সৈনিক হিসেবে নিয়োগ করেছে এই যুদ্ধে।

রাখাইনে ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। তখন সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালায় বলে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলাও চলছে। আবার আরাকান আর্মিও রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর ৬০০ জনকে হত্যার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। তবে বিদ্রোহী দলটি সেই অভিযোগ অস্বীকার করছে। বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক শাখা ইউএলএর দাবি, রাখাইনে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় মুসলিম বাসিন্দারা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো জীবনযাপন করছে। ইউএলএও সামরিক সরকারের মতোই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করতে চায় না। তারাও বোঝাতে চায় যে এই সম্প্রদায় রাখাইনের আদি বাসিন্দা নয়।

পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে তখন, যখন সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিনের আচরণের বিপরীতে গিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সতর্ক করেছে, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদেরও আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্ররোচিত করছে। কিন্তু আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা বিদ্রোহ সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে না আইসিজি।

চীন নির্মিত বন্দরের জন্য যুদ্ধ:

সিত্তের দক্ষিণে কিয়াউকপিউর জন্য একটি চূড়ান্ত লড়াই আসন্ন, যা দুটি তেল ও গ্যাস পাইপলাইন এবং একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে মিয়ানমারকে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই বন্দর চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো প্রকল্পের অংশ। ব্যাংককভিত্তিক প্রতিরক্ষাবিষয়ক প্রকাশনা জেনেসের বিশ্লেষক অ্যান্থনি ডেভিস পূর্বাভাস দিয়েছেন, আরাকান আর্মি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে একটি অভিযান শুরু করতে পারে।

তারা মেঘলা আকাশকে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধবিমানের বিমান হামলা থেকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করবে, যা কিয়াউকপিউ দখলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে। ডেভিস বলেন, ২০২৪ সালে আরাকান আর্মি যে গোলাবারুদ জমিয়েছে, তা ২০২৬ সালের মধ্যে কমে যেতে পারে, আবার চীনের চাপে উত্তর মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ কমতে পারে। সে কারণেই আরাকান আর্মির অভিযান শুরু করার এত তাড়া। বর্তমানে সেনাবাহিনীর ৩ হাজার পদাতিক সৈন্য, জেট, ড্রোন এবং নৌবাহিনী কিয়াউকপিউর নিরাপত্তায় মোতায়েন রয়েছে। ডেভিস বলেন, আরাকান আর্মির নতুন নিয়োগে তারা ৪০ হাজার সদস্যের বাহিনীতে রূপ নেবে। সম্ভবত কিয়াউকপিউ আক্রমণে ১০ হাজারের বেশি সৈন্য নিযুক্ত করবে। আরাকান আর্মির বন্দরটি দখল করার সক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক, তাহলে তা হবে গৃহযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়।

চীনের একটি সূত্র অনুযায়ী, কিয়াউকপিউতে প্রায় ৫০ জন চীনা নিরাপত্তা কর্মী রয়েছেন। ডেভিস ধারণা করেন, নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণœ থাকার নিশ্চয়তা পেলে হয়তো বেইজিং আরাকান আর্মিকে সমর্থন দেবে। যদিও বেইজিং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের প্রতি তাদের সমর্থন বাড়িয়েছে; তবে ইউএলএর প্রতিনিধি বলেন, চীনের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বনে তারা সচেষ্ট।

যুদ্ধের বিস্তার বাড়ছে: রাখাইনে কালাদান পরিবহন প্রকল্পের কারণ, স্বার্থ রয়েছে ভারতেরও। এই প্রকল্পের লক্ষ্য দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সিত্তে বন্দরের মাধ্যমে সমুদ্রপথে সংযুক্ত করা। এই করিডর ভারতকে বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্য পথ তৈরি করে দিচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, রাখাইনে বন্দর, সড়ক ও নদী নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মিকে ভারতীয় বাণিজ্য থেকে কর আদায়ের সুযোগ করে দিতে পারে; যা তার আর্থিক সক্ষমতা বাড়াবে, একই সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নতুন দিল্লির সম্পর্ককে দুর্বল করবে। যদি আরাকান আর্মি রাখাইনের উপকূলীয় বন্দরগুলো দখল করতে সফল হয়, তাহলে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি চীন ও ভারত উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন এবং বাণিজ্য প্রবেশদ্বারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। এতে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে অন্য যেকোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর চেয়ে তাদের শক্তিকে এগিয়ে দেবে।

ডেভিস বলেন, এটা ঘটলে তা আরাকান আর্মি সমর্থিত আরাকান পিপলস রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্টকে একটি আঞ্চলিক ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মিয়ানমার বলছে, আরাকান আর্মি রাখাইনের বাইরেও তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে এবং এখন দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সবচেয়ে বড় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্য কোনো জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশের পরবর্তী প্রজন্মের যোদ্ধাদের মধ্যে এত বিস্তৃত প্রভাব ফেলতে পারেনি।

কিন্তু যুদ্ধের মধ্যেই সামরিক সরকার যখন ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন এমন ঘটতে পারে যে আরাকান আর্মি যুদ্ধবিরতিতে যাবে, আবার এমনও হতে পারে যে লড়াই চালিয়ে যাবে। তবে ইউএলএর প্রতিনিধির কথায় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতই মিলছে। তিনি বলেন, আমরা আত্মবিশ্বাসী যে প্রতিরোধ বাহিনী দেশে অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারবে।

২০ লাখের বেশি মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে: মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এএ) বিদ্রোহীদের দ্রুত অগ্রযাত্রা দেশটির গৃহযুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। চলমান যুদ্ধের মধ্যেই রাখাইনে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, অঞ্চলটিতে ২০ লাখের বেশি মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাবে, রাখাইনের অর্ধেকেরও বেশি পরিবার ন্যূনতম খাবারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।

২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বিমান হামলা জান্তা সেনাদের প্রধান অস্ত্র। গত দেড় বছরে রাখাইনে এসব হামলায় ৯৬ শিশুসহ অন্তত ৪০২ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এদিকে উভয় পক্ষই জোর করে যুদ্ধক্ষেত্রে নামাচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের। বিদ্রোহীরা ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সি পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সি নারীদের জোর করে অস্ত্র ধরাচ্ছে। আবার বাধ্যতামূলকভাবে প্রায় ৭০ হাজার সৈন্য নিয়োগ দিয়েছে জান্তা বাহিনী। 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!