সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রেজাউল করিম, রংপুর

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ১২:৪৮ এএম

টোলের নামে চাঁদাবাজির  - টাকা যায় উপরমহলে

রেজাউল করিম, রংপুর

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ১২:৪৮ এএম

টোলের নামে চাঁদাবাজির  - টাকা যায় উপরমহলে

উত্তরের পানিপ্রবাহের একমাত্র মাধ্যম তিস্তা ব্যারাজ। এই ব্যারাজ লালমনিরহাট ও নীলফামারীর সংযোগস্থল হলেও তিস্তার পানিপ্রবাহের জন্য ৫২ কপাটবিশিষ্ট এই ব্যারাজটি নির্মাণ হয় ১৯৮৮ সালে। ভারতের পানি আগ্রাসনের হাত থেকে উত্তরের ৫ জেলাÑ রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলাকে রক্ষা করার জন্যই এই ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ব্যারাজটি চাঁদাবাজির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যখন যে সরকার আসে, সে সরকারের দলীয় নেতাকর্মীরা টোল আদায়ের নামে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায় করেন পরিবহন থেকে। কিন্তু সুশীল সমাজের প্রশ্ন, তিস্তা ব্যারাজের টোলের নামে চাঁদাবাজির টাকা যাচ্ছে মূলত কার পকেটে। 

ব্যারাজ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, এই ব্যারাজ থেকে প্রতিদিন ১৫ লাখ টাকার চাঁদাবাজি হয়। আমাদের বলার কিছুই নেই। আমরা যদি বাধা দেই তাহলে আমাদের চাকরি থাকবে না। এমন বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে হুমকির মুখে পড়েছে ব্যারাজটি। বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়েছে ফাটল। শুধু তাই নয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জায়গা দখল করে নানা স্থাপনা তৈরি করছে বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় আসা সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, রংপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, আমরা চেষ্টা করছি, ব্যারাজকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো অপকর্ম না হয়। আর পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম বলেন, ’২৪-এর বিপ্লবের পর ব্যারাজে তেমন কোনো চাঁদাবাজির খবর আমাদের কাছে নেই। তথ্য পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
উত্তরাঞ্চলের কৃষির প্রাণ তিস্তা ব্যারাজ এখন পরিণত হয়েছে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মাদক ও জমি দখলের অভয়ারণ্যে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় এই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। সময় থাকতে ব্যবস্থা না নিলে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প হারাতে বসবে তার মূল উদ্দেশ্যÑ কৃষকের জীবন বাঁচানো আর খরাপীড়িত জনপদে সেচের পানি পৌঁছে দেওয়া।

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে ব্যারাজের ২৪, ২৭ ও ২৮ নম্বর গেটে ফাটল দেখা দিলে তৎকালীন প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। কাগজে-কলমে টোল আদায় বন্ধ হলেও বাস্তবে শুরু হয় চাঁদাবাজির নতুন অধ্যায়। স্থানীয়দের সাক্ষ্য ও গোপন কাগজপত্রে ওঠে আসে, প্রতিটি ট্রাক থেকে ওঠা টাকার ভাগ পৌঁছাত সাবেক সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন ও তার ছেলে মাহমুদুল হাসান সোহাগের কাছে। বর্তমানে হাতবদল হলেও সাবেক সংসদ সদস্য মোতাহারের সাবেক এপিএস সিদ্দিকুর রহমান শ্যামল এবং নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে এ সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় রয়েছে। সাথে যোগ হয়েছে বিএনপি, জামায়াতের নেতাকর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হাতিবান্ধা, পাটগ্রাম ও ডিমলা উপজেলার বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা জোট করে এ চাঁদাবাজিতে নেমেছে। 

প্রকৌশলীদের নকশা অনুযায়ী, ব্যারাজ সর্বোচ্চ ২০ টন ভার বহনে সক্ষম। কিন্তু প্রতিদিন ৩০-৪০ টন মালবোঝাই ৩০০-৩৫০টি ট্রাক ব্যারাজ দিয়ে চলাচল করছে। এক আনসার সদস্য বলেন, প্রতিটি ট্রাক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ওঠে। আমরা শুধু দায়িত্ব পালন করি, আসল ভাগ যায় উপরের দিকে। সরকারি নথি বলছে, ব্যারাজ থেকে ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার কথা। কিন্তু মাঠঘাট ঘুরে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ২৫-৩০ হাজার হেক্টরে পানি পৌঁছায়। সেচ ক্যানেলগুলো দখল হয়ে গেছে প্রভাবশালীদের হাতেÑ গড়ে উঠেছে কোথাও বাজার, কোথাও বহুতল ভবন। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ‘রক্ষণাবেক্ষণ খাতে’ খরচ দেখাচ্ছে।

আইন অনুযায়ী, ব্যারাজের এক কিলোমিটার আশপাশে কোনো খনিজ উত্তোলন চলার কথা নয়। কিন্তু ক্যামেরায় ধরা পড়েছে ব্যারাজের গা-ঘেঁষে বোমা মেশিন বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। ফলে নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, ঝুঁকিতে পড়ছে ব্যারাজ। ড্রেজার মেশিন অচল ফেলে রেখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবৈধ মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, আমরা একাধিকবার লিখিতভাবে জানিয়েছি, কিন্তু অনুমতি আটকে দেয় সেই সিন্ডিকেট।

পুলিশ ও র‌্যাবের নথি বলছে, গত এক বছরে ব্যারাজ এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে ১ হাজর ২০০ বোতলের বেশি ফেনসিডিল ও কয়েক হাজার ইয়াবা। স্থানীয়দের প্রশ্ন, শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা, আনসার ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের পাহারা থাকা সত্ত্বেও মাদক কীভাবে ব্যারাজ অতিক্রম করে? উত্তর মেলেনি কারো কাছ থেকে। দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুটি স্কেল বছরের পর বছর অকেজো। সচল হলে ২০ টনের বেশি গাড়ি পার হতে পারবে না। তখন সিন্ডিকেটের আয় বন্ধ হয়ে যাবে।

রাজনৈতিক প্রভাব আর অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে স্কেল মেরামত আটকে রাখা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণকৃত ৩ হাজার ৫০০ হেক্টরের বড় অংশ এখন রাজনৈতিক নেতাদের দখলে। ডালিয়া নতুন বাজার, ঝুনাগাছ চাপানী হাটসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে দোকানঘর ও বহুতল ভবন। এমনকি বোর্ডের অবসর কটেজের পাশের পুকুরও দখলে নিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন। তিনি অকপটে বলেন, ‘আমার ঠ্যাপেই অনেক কিছু হয়। বোর্ডের পুকুরে আমরা মাছ ছাড়ি, তারাও ধরে। এটা কোনো অপরাধ না।’ স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুর রহমান বলেন, ব্যারাজ রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সঠিকভাবে ব্যবহার হলে আমরা সুখে থাকতে পারতাম। কৃষকরা সেচ পেত, পর্যটক আসত। কিন্তু এখন ব্যারাজ দুর্নীতির আখড়া। 

স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন ৩০০-৪০০ মালবাহী ট্রাক ব্যারাজ অতিক্রম করে, বিশেষ করে পাটগ্রাম ও বুড়িমাড়ী স্থলবন্দর থেকে আসা পাথর, কয়লা ও বালুবোঝাই গাড়ি। এসব থেকে আদায় হওয়া টাকা ভাগ হয় পুলিশ, আনসার, দালাল অফিস ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (যান্ত্রিক) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, ব্যারাজের ওপর দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ টন পর্যন্ত পরিবহন পারাপারের সুযোগ আছে। স্কেল সংস্কারের চাহিদা দেওয়া হয়েছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ব্যারাজ দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। নিষ্কাশন খাল সংস্কারের জন্য ৩৫টি প্যাকেজে কাজ চলছে, ১০টি শেষ হয়েছে। জমি উদ্ধারে বাজেট প্রাপ্তির পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা অসহায়।

নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিভারাইন পিপল’-এর চেয়ারম্যান ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তার প্রবাহ ঠিক না থাকায় প্রতিবছর বন্যায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ব্যারাজের অনিয়মে নীলফামারী, লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামসহ পুরো অঞ্চল ঝুঁকিতে পড়ছে। কর্তৃপক্ষের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আর ব্যারাজ ঘিরে যে চাঁদাবাজি হচ্ছে তা বন্ধে প্রশাসন ব্যর্থ।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!