শহর কিংবা গ্রামÑ হাত বাড়ালেই মিলছে নানা ধরনের মাদকদ্রব্য। বলা চলে, বেশ সহজলভ্যও। যার গ্রাহক অধিকাংশই তরুণ। ফলে সমাজ ও পরিবারের মধ্যে চাপা আতঙ্কÑ মরণঘাতী মাদকের ছোবলে তরুণ প্রজন্ম যেন হারিয়ে না যায়। প্রায় প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্তে মাদকসহ গ্রেপ্তার হলেও বিক্রি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদিকে অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীদের অন্যতম রুট ও বাজারে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীতে এক দিনে মাদকবিরোধী অভিযানে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ কোকেনসহ বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। গত মঙ্গলবার ভোরে বাংলাদেশ কাস্টমস ও (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর) ডিএনসির যৌথ অভিযানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৮ কেজি ৬০০ গ্রাম কোকেনসহ আটক হন গায়ানার নাগরিক কায়রান পেটুলা। এটি দেশের ইতিহাসে একক অভিযানে উদ্ধার হওয়া সর্বোচ্চ পরিমাণ কোকেন। এর আগে সর্বোচ্চ ৮ কেজি ৩ গ্রাম কোকেন উদ্ধার হয়েছিল।
ডিএনসি সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ আগস্ট রাজধানীর আদাবর থানার বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটির একটি ভবনে অভিযান চালিয়ে খাইরুল ইসলাম রিয়ান (২৬) নামের এক যুবককে চার হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একই দিন শেখেরটেক এলাকায় আরেক ভবনে অভিযান চালিয়ে একাধিক মামলার আসামি মিলন মোল্লার কাছ থেকে ১ কেজি ৬০০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ বা আইস উদ্ধার করা হয়।
অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমনিতেই মাদকের ভয়াল থাবায় ধ্বংস হচ্ছে যুবসমাজ। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার দেশে বিপুল পরিমাণ ভয়ংকর কোকেন জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তারা বলছে, বর্তমান সমাজে নতুন রূপে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কোকেন। এসব মাদক নিয়ে পুরো জাতি শঙ্কিত, আতঙ্কিত। বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীদের অন্যতম রুট ও বাজারে পরিণত হয়েছে। আফ্রিকা, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, ভারত, মিয়ানমার, মালাবি থেকে শুরু করে ইউরোপ ও আমেরিকার মাদক কারবারিদের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে।
দেশে কোকেন ও হেরোইনের অধিকাংশ চালান আসে আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার নাগরিকদের মাধ্যমে। ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে এবং ফেনসিডিল-গাঁজা ভারত থেকে। সীমান্তের ৯৫টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক প্রবেশ করে, যার মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের ৯টি জেলার ৫১টি পয়েন্ট সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। মাদক কারবারদের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশকে এখন হেরোইন ও কোকেনের ‘ভিআইপি রুট’ হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক চক্র। যদিও দেশে এ মাদকের চাহিদা তুলনামূলক কম, কিন্তু আন্তর্জাতিক পাচারের জন্য এটি নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছেÑ মাদক কেনাবেচায় ডার্ক ওয়েব ও বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার। পরিচয় গোপন রেখে ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হয় নিষিদ্ধ মাদক, যা শনাক্ত করাও কঠিন। সম্প্রতি এ মাধ্যমে মাদক কিনে দেশে আনা এবং পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বনাশা মাদক। বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। লাগামহীন বিস্তারে শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে মাদকসেবী ও বহনকারীকে আটক করতে সক্ষম হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে মূল হোতারা। সম্প্রতি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়া কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের কোকেনের গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশে ভারত। গ্রেপ্তার হওয়া বিদেশি নাগরিকের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে কারা তাদের আশ্রয়দাতা এবং কাদের ইন্ধন ও সহযোগিতায় এ ধরনের মাদকের চালান আনা হয়েছে, সে বিষয়টি এখনো সামনে আসেনি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সফলভাবে বিমানযোগে বাংলাদেশে আসেন বিদেশি ওই নাগরিক। এরপর তিনি হোটেলে উঠবেন বলে কথা ছিল। তার আগেই তাকে ধরা পড়তে হয়েছে। তবে এর সঙ্গে বিশেষ কোনো যোগসূত্রে আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর সঙ্গে বিমানবন্দরের কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্টদের কেউ জড়িত কেউ জড়িত কি না, সে তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা।
সূত্র জানিয়েছে, এর আগেও বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কোকেনের চালান ধরা পড়ে। জব্দ হওয়া ওই সব কোকেন এসেছিল ইউরোপ ও অফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। বাংলাদেশকে শুধু মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করার কয়েকবার চেষ্টা হয়, যা পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কোনো মাদক মাফিয়ার সঙ্গে জড়িত কি না, সেটিও জানতে সম্মিলিতভাবে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক গোলাম আজম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, যাত্রাবাহী ফ্লাইটগুলোয় যাত্রীদের মালপত্রের মধ্যে মাদক পাচার করে আসছিল একটি চক্র। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিদেশি নাগরিকেরা ধরাও পড়ছে। এর মধ্যে কোকেনও রয়েছে। বাংলাদেশে কোকেনের ব্যবহার কম। কোকেনের এত বড় চালানের সঙ্গে বাংলাদেশি মাদক মাফিয়াদের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। এ জন্যই জব্দ হওয়া কোকেন নিয়ে তদন্ত ও যাচাই-বাচাই চলছে। বিদেশি মাদক মাফিয়াদের সঙ্গে বাংলাদেশি মাদক মাফিয়াদের জব্দ হওয়া কোকেনের বিষয়ে কোনো যোগসূত্র বা যোগাযোগ আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
কোকেনের গন্তব্য বাংলাদেশ ছিল কি না, এ বিষয়ে গোলাম আজম জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ওই নারী ব্রাজিল থেকে কোকেন সংগ্রহ করে নিউইয়র্ক হয়ে কাতারের দোহার মাধ্যমে ঢাকায় প্রবেশ করেন। বাংলাদেশে কোকেনের উল্লেখযোগ্য বাজার নেই, তাই এটি অন্য কোনো দেশে পাচারের উদ্দেশ্যে আনা হয়ে থাকতে পারে। তদন্ত শেষে এটির গন্তব্য কোথায় ছিল, তা জানা যাবে। এর আগেও আমরা অনেক মাদক কারবারিকে ধরেছি এবং মাদক চোরাচালান ও নিয়ন্ত্রণে ডিএনসি কঠোরভাবে কাজ করছে।
মূল হোতারা গ্রেপ্তার না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসি প্রধান বলেন, ‘মাদকের মামলাগুলো সাধারণত যাদের কাছ থেকে মাদক উদ্ধার হয়, তাদের বিরুদ্ধেই হয়। মূল হোতাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করা কঠিন। এ জন্য আমরা তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করি। এখন পর্যন্ত ১২টি মানি লন্ডারিং মামলা হয়েছে এবং ২৭টি তদন্তাধীন।’