সিলেটের বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে চলছে বদলি আতঙ্ক। সিভিল প্রশাসন, পুলিশ এবং বিজিবিতে এই আতঙ্ক এখন ছেয়ে বসেছে। বিশেষ করে কোয়ারি এলাকা এবং এ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে ইতোমধ্যে বদলি শুরু হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে বেশি।
সিলেটে সাম্প্রতিক সময়ে পাথর, বালু এবং টিলা লুটপাটে জড়িত ও সহায়তার অভিযোগ উঠেছে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে ও গণমাধ্যমের খবরে সুনির্দিষ্টভাবে উঠে এসেছে তাদের নাম।
এরপরই তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে অ্যাকশনে যায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। ইতোমধ্যে সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশের ৩ কর্মকর্তাকে আলোচিত এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত বাকিদের বদলির প্রক্রিয়া চলছেÑ এমনটাই জানিয়েছে প্রশাসনের একটি সূত্র।
সিলেট বিভাগ গণদাবি ফোরামের সভাপতি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট চৌধুরী আতাউর রহমান আজাদ বলেন, যাদের নামে অভিযোগ, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়মুক্তির সুযোগ নেই। সুযোগ দিলে সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য ২৪-এর বিপ্লব হয়েছে। তাই বিষয়টি যেন শুধু বদলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা না হয়।
যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, সাদাপাথর লুটের সাথে জড়িত কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। প্রশাসনের যাদের জড়িত থাকার অভিযোগ, তারাও পার পাবেন না।
গতকাল সোমবার সিলেটের জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে মতবিনিময় শেষে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাদাপাথর লুট এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদন আমরা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। প্রতিবেদনটি সত্য প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পাথর ও বালুকা- সিলেটে আলোচিত হবার পর বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে জাফলং, বিছানাকান্দি, ভোলাগঞ্জে পাথর ও বালু লুট হচ্ছে। এ নিয়ে পত্রিকায় নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ হলেও খুব একটা আমলে নেওয়া হয়নি বিষয়টি। সরকারি নির্দেশে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে অনেকদিন ধরে সিলেটের পাথর ও কিছু বালু মহাল বন্ধ রয়েছে। মূলত আদালতের রায় থাকায় বাণিজ্যিকভাবে বালু বা পাথর তোলা নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও গেল সরকারের আমলে অনেকটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বন্ধ থাকা কোয়ারিগুলো থেকে পাথর ও বালু লুটপাট অব্যাহত থাকে। তবে সেটি ছিল গোপনে এবং অল্প।
কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর লুটপাট শুরু হয় প্রকাশ্যে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় দলমত নির্বিশেষে বালু ও পাথরখেকোরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মহালগুলোর ওপর। তাদের থাবায় বিলীন হয়ে যায় সাদাপাথর, জাফলং, বিছানাকান্দি, রাংপানি কোয়ারি। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায় বিশাল এলাকার শাহ আরেফিন টিলাও!
মূলত গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন থেকে প্রশাসনের শিথিলতার সুযোগে শুরু হয় বেপরোয়া পাথর লুট। প্রকাশ্যে প্রশাসনের সামনে গত এক বছরে লুটে নেওয়া হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথরের সব পাথর। মাঝেমধ্যে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর তৎপরতায় কিছুদিন বন্ধ থাকে লুটপাট। তবে চলতি বছরের গেল জুলাই মাসের শেষভাগে লুটপাট চূড়ান্ত মাত্রা পায়। এরপর মাত্র ১৮ দিনে নিঃশেষ হয়ে যায় সাদাপাথর। হারিয়ে যায় অন্তত দুইশ কোটি টাকার পাথর। লুটপাট করে পর্যটন কেন্দ্রের চেহারা পাল্টে দেওয়া হয়। লুটে সাবাড় করা হয় রেলওয়ের রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকা। কয়েক হাজার বছরের পুরোনো শাহ আরেফিন টিলা নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। সেখানে থাকা আল্লাহর ওলি হযরত শাহ আরেফিন রহ.-এর মাজার এলাকাও গিলে ফেলে বালু ও পাথরখেকোরা। এমনকি মাজার ও মসজিদ নিশ্চিহ্ন করতে উদগ্রীব তারা।
লুটেপুটে খাওয়ার এ উৎসব চারদিকে চলে সিলেট এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায়। আর তাদের সহায়তা করেন প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা। এই লুটপাট ঠেকাতে তাদের দায়িত্ব থাকলেও তারা ছিলেন উল্টো সহযোগী। দুর্নীতির কারণে তারা থাকেন নীরব। ফলে দিনশেষে তাদের পকেট ভারি হতে শুরু করে। কিন্তু খালি হয়ে যায় সাদাপাথর, পিয়ান নদীর বুক, বিছানাকান্দি, রাংপানি! চারদিকে অবশিষ্ট থাকে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ।
সাদাপাথর লুটের মহোৎসবে পর্যটন সৌন্দর্য নষ্ট হলে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। টনক নড়ে প্রশাসনের। নড়েচড়ে বসে সরকার। তারপর একে একে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নাম উঠে আসে লুটকা-ে। নাম জড়িয়ে যায় সরকারি কর্মকর্তাদেরও। গোয়েন্দা তথ্যসহ দুদকের তদন্তে লুটপাটে জড়িত, উৎসাহদান ও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সহায়তার অভিযোগ উঠে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, তৎকালীন সিলেটের জেলা প্রশাসক, সিলেট জেলা পুলিশ সুপার, স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওসির বিরুদ্ধে।
বিষয়টি উপর মহলে আলোচনার টেবিলে পৌঁছালে সমালোচনার মুখে দ্রুত প্রথমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহারকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তার কয়দিন পর সিলেটের বিতর্কিত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করে ওএসডি করা হয়। গত রোববার বদলি করা হয় মাহবুব মুরাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ও কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনানকে। অভিযোগ আছেÑ এই তিনজন মিলেই সাদাপাথরের চেহারা পাল্টে দিতে লুটেরাদের সর্বোচ্চ সুবিধা করে দিয়েছেন। গত ২৬ আগস্ট এই অভিযোগে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট থানায় কর্মরত ১১ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি করা হয়। তাদের মধ্যে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই)ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন।
সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঘোর অভিযোগের পর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহারকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে এবং ফেঞ্চুগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে কোম্পানীগঞ্জে বদলি করা হয়। জায়গার এই অদলবদলে প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে আলোচনা শুরু হলে ২৪ ঘণ্টার মাথায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। আরেক আদেশে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে পাঠানো হয় হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় এবং সেখানকার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিন মিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। আজিজুন্নাহারকে শাস্তিমূলক বদলি করে সিলেট জেলার আরেক বালুমহাল এলাকায় রাখায় তীব্র সমালোচনা হয় প্রশাসনসহ গণমাধ্যমে। অনেকে বলছেন, আজিজুন্নাহারকে মূলত শাস্তি নয়, সেইফ জোনে নেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বদলি হওয়া অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বাইরেও প্রশাসন, পুলিশ ও বিজিবির আরও অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন যারা পাথরকা-ে জড়িত। তদন্তে তাদের নাম এলেও এখনো তারা প্রতিষ্ঠানিক শাস্তির মুখোমুখি হননি। রয়েছেন বহাল তবিয়তে। যদিও তাদের মাঝে বদলি আতঙ্ক বিরাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, যেকোনো সময় বদলির আদেশ আসতে পারে বিভাগীয় কমিশনার অফিস ও জেলা পুলিশের কর্তাদের নামে।
সেই তালিকায় আছেন জেলা প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা, যাদের বিরুদ্ধে সাবেক জেলা প্রশাসককে প্রভাবিত করে পাথর থেকে সুবিধা নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আছেন গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিরা। এ ছাড়াও উপজেলাগুলোর তপশিল অফিসের কর্মকর্তারা পাথরলুটে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
সূত্র জানায়, বিজিবির নাম পাথরকা-ে জড়ালেও এ নিয়ে তাদের কোনো উদ্যোগ বা ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য নেই। সাদাপাথর ও জাফলংয়ে তাদের চোখের সামনেই পাথর, বালু ও রেলের বাঙ্কার লুটে নেওয়া হয়। তারা ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। অভিযোগ আছে, বড় অঙ্কের মাসোহারা পেয়ে সদস্যরা মুখ ও চোখ দুটোই বন্ধ রেখেছিলেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে তদন্ত শুরুর আগেই কিছু কর্মকর্তাকে বদলি করে দায় শেষ করা যায় না। যারা প্রকৃতভাবে দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই বদলি শুধু একটি নাটক হয়ে থাকবে।’ তার মতে, অপরাধীদের বদলি করে রাখলে তা তাদের রক্ষা করার শামিল। তিনি বলেন, এতে জন আস্থা কমে যায় এবং দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হয়। কেবল বদলির মাধ্যমে শুদ্ধি অভিযান সম্ভব নয়; প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্ত, জবাবদিহিতা এবং দ্রুত বিচার।