সংগীত উপযোগী শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্রই হলো বাদ্যযন্ত্র। কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীতে এসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। কানাডা ও চীনের একদল বিজ্ঞানীর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা জীবনের একটা বড় সময় ধরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছেন, তাঁদের মস্তিষ্ক বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুর্বল হয় না। বয়স হলেও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বেশি কার্যকর ও তীক্ষè থাকে। অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র বাজালে তরুণ থাকে মস্তিষ্ক।
ভারতীয় উপমহাদেশে খননকার্য ও প্রাচীন সাহিত্য থেকে অতি উন্নতমানের এক সাংগীতিক সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রেরও পরিচয় মেলে। সিন্ধু সভ্যতায় বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। বৈদিক যুগে দুন্দুভি, ভূমি-দুন্দুভি, বেণু, বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বয়স্ক ব্যক্তি বাদ্যযন্ত্র বাজান তারা, যারা বাদ্যযন্ত্র বাজান না, তাদের তুলনায় শব্দ ও কথোপকথন বেশি কার্যকরভাবে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অভিজ্ঞতা থাকা বয়স্করা এমনকি হট্টগোলপূর্ণ পরিবেশেও কথোপকথন বুঝতে পারেন। আশ্চর্যজনকভাবে, তাদের মস্তিষ্ক তরুণদের মতো কার্যকরভাবে কাজ করে, মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে কম শক্তি লাগে।
গবেষণার ফল অনুযায়ী, সংগীত প্রশিক্ষণ মস্তিষ্কে একটি ‘স্মৃতিকৌশল সংরক্ষণ’ বা ‘কগনিটিভি রিজার্ভ’ তৈরি করে, এটি একটি ব্যাকআপ সিস্টেম যা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কার্যকারিতা বজায় রাখে। গবেষকরা বলেন, ‘এমনকি অনেক বছর পরও, সংগীতজ্ঞদের মস্তিষ্কে তরুণদের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।’ তারা আরও বলেন, ‘সংগীতমূলক কার্যক্রম স্নায়ু পথগুলোকে আরও স্থিতিশীল রাখে’।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বাদ্যযন্ত্র বাজানো মস্তিষ্কের এমন অঞ্চলগুলোর সংযোগকে শক্তিশালী করে যা শোনা, ভাষা ও চলাফেরার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই সংযুক্তি সংগীতজ্ঞদের জন্য জটিল বা হট্টগোলপূর্ণ পরিবেশে শব্দ ও কথোপকথন আলাদা করা সহজ করে। তুলনামূলকভাবে, যেসব বয়স্ক ব্যক্তি সংগীত প্রশিক্ষণ পাননি, তাদের মস্তিষ্ককে কথোপকথন ফিল্টার করতে ও মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয়। এই ফল দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের শব্দ প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। গবেষকরা সুপারিশ করছেন, সংগীতের সঙ্গে যুক্ত থাকা এই অবনতিকে প্রতিরোধ করতে পারে। এই গবেষণায় যুক্ত প্রধান একজন বৈজ্ঞানিক বলেন, ‘সংগীত কেবল একটি শিল্প নয়Ñ এটি মস্তিষ্কের জন্য একটি ব্যায়াম।’
গবেষণার ফল আরও প্রমাণ দিয়েছে-সংগীত কগনিটিভ স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সাংস্কৃতিক ও আবেগগত মূল্য ছাড়াও, বাদ্যযন্ত্র শেখা বা বাজানো অব্যাহত রাখা মস্তিষ্ককে বয়সজনিত প্রভাব থেকে রক্ষা করার একটি শক্তিশালী উপায় হতে পারে।
মানুষের জীবনে তারুণ্য থেকে বার্ধক্যে যাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে আসে। তাই বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কারণে দীর্ঘদিন মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতায় তারুণ্যের ভাব থাকে।
বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ধরে রাখার এই কৌশলকে কগনিটিভ রিজার্ভ বলে। বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কারণে মস্তিষ্কে একধরনের কগনিটিভ রিজার্ভ বা জ্ঞাননির্ভর দক্ষতা মনে রাখার অভ্যাস তৈরি হয়। মস্তিষ্কের একটি ব্যাকআপ সিস্টেম বলা হয় একে। এই কৌশল ভবিষ্যতে মস্তিষ্কের দক্ষতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। বয়স বাড়লে যেন মস্তিষ্ক কম শক্তি খরচ করে কাজ করতে পারে, তার জন্য এই কাঠামো কাজ করে। সপ্তাহে ১২ ঘণ্টা বাদ্যযন্ত্র বাজালে এমন কাঠামোর বিকাশ ঘটে। এ বিষয়ে চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের বিজ্ঞানী ই ডু বলেন, বছরের পর বছর বাদ্যযন্ত্র বাজানোর প্রশিক্ষণের কারণে একজন বয়স্ক বাদ্যযন্ত্রী বা সংগীতশিল্পীর মস্তিষ্ক সূক্ষ্মভাবে সুরযন্ত্রের মতো কাজ করে।