শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সামজীদ হোসেন 

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ১২:০৬ এএম

প্রতিবন্ধী কল্যাণের আড়ালে ইউসুফের প্রতারণার সাম্রাজ্য

সামজীদ হোসেন 

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ১২:০৬ এএম

প্রতিবন্ধী কল্যাণের আড়ালে ইউসুফের প্রতারণার সাম্রাজ্য

নরসিংদী জেলার মনোহরদীর মোবারক হোসেন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। মা-বাবা নেই, নেই আশ্রয় ও এক মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা। মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্যে দিন কাটে প্রতিবন্ধী মানুষটির। কারও দেওয়া খাবারে একবেলা চলে, আবার কখনো না খেয়েও রাত কাটাতে হয় তাকে। মানুষের সহানুভূতির ওপর নির্ভর করেই চলছে মোবারকের বেঁচে থাকা। অথচ একই এলাকায় প্রতিবন্ধীদের কল্যাণের নামে প্রতারণার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন মোহাম্মদ ইউসুফ হাসান। একদিকে মোবারকের মতো অসহায় মানুষগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছেন, অন্যদিকে প্রতিবন্ধী কল্যাণের স্লোগানে শতাধিক পরিবারকে সর্বস্বান্ত করেছেন ইউসুফ হাসান।

সূত্র জানায়, অভাব-অনটনের সংসারে জন্ম মোহাম্মদ ইউসুফ হাসানের। শৈশবে এতিমখানা ও স্থানীয় স্কুলে অল্প পড়াশোনা করলেও কিশোর বয়সেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন তিনি। জীবনের শুরুটা নিরীহ মনে হলেও সময়ের সঙ্গে বদলে যায় ইউসুফের পরিচয়। জীবিকার সন্ধানে একসময় জড়িয়ে পড়েন বিমা কোম্পানি, হাসপাতাল ও পাসপোর্ট অফিসে দালালির ব্যবসায়। এখানেই শুরু তার প্রথম প্রতারণার অভিজ্ঞতা। পরবর্তী সময়ে ভুয়া ‘এমএলএম’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্রামের অসংখ্য মানুষকে সর্বস্বান্ত করেন তিনি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে সেই সুযোগ হাতছাড়া করেননি ইউসুফ। ২০০৯ সালে মনোহরদী উপজেলার গোতাশিয়া ইউনিয়নের চুলা গ্রামে ‘মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন ইউসুফ।  স্থানীয় তোতা মিয়াকে ফুসলিয়ে তার ১২০ শতাংশ জমির পর প্রতিষ্ঠা করা হয় বিদ্যালয়টি। এরপর বিদ্যালয়ের আড়ালে প্রতারণার মহোৎসব শুরু করেন ইউসুফ। শতাধিক মানুষকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এবং ধার নেওয়ার নামে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। 

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সহকারী শিক্ষক, থেরাপিস্ট ও অফিস সহায়কÑ সব ধরনের পদে নিয়োগ দেওয়ার নাম করে তিনি প্রায় ৫৫ জনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া স্থানীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরও কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ইউসুফ। মানুষের আস্থা অর্জন করতে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে প্রতিশ্রুতি দলিল দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাংক চেক দিয়ে পাওনা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখেননি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চাকরির আশ্বাসে হাতিয়ে নেওয়া কোটি কোটি টাকায় ইউসুফ কিনেছেন একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। নরসিংদী, পাঁচদোনা ও গাজীপুরে রয়েছে তার স্থাবর সম্পত্তি।  সূত্রের দাবি, বর্তমানে তিনি গাজীপুরের গাছা থানার হারিকেন এলাকার একটি আলিশান ফ্ল্যাটে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করছেন। প্রতারিতরা যাতে তাকে সহজে খুঁজে না পান, সে জন্য ইউসুফ প্রায়ই ঠিকানা পরিবর্তন করেন। পাশাপাশি মোবাইল নম্বরও বারবার বদলান। এতে ভুক্তভোগীরা টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে বিপাকে পড়েন।

স্থানীয়রা বলছেন, ইউসুফের চলাফেরায় কোনোভাবেই বোঝা যায় না তিনি সাধারণ পরিবারের সন্তান। বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন, দামি পোশাক পরেন এবং মানুষের কাছে নিজেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেন। 

ভুক্তভোগী আজিজুন নাহার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাকে প্রধান শিক্ষক করার আশ্বাস দিয়েছিলেন ইউসুফ হাসান। গ্রামের মানুষের সামনে তিনি বলেছিলেন, ‘চাকরি নিশ্চিত, শুধু বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য কিছু টাকা দরকার।’ বিশ্বাস করে নিজের গচ্ছিত সঞ্চয় থেকে ৭ লাখ টাকা তুলে দিলাম। এমনকি আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও ধার করতে হলো। টাকা নেওয়ার সময় ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেনÑ চাকরি না হলে টাকা ফেরত দেবেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিও তিনি রাখেন নাই।’ 

আজিজুন নাহার আরও বলেন, ‘চাকরি হলো না, টাকা ফেরতও পেলাম না। উল্টো ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আজ আমি নিঃস্ব। সংসারের নিত্যদিনের খরচ চালানোই কঠিন হয়ে উঠেছে। সমাজে এখন সবাই আমাকে সন্দেহের চোখে দেখেÑ কেউ বলে আমি নিজেই হয়তো প্রতারণার খেলায় ছিলাম, কেউ বলে মাথামোটা হয়ে টাকাটা নষ্ট করেছি। আত্মীয়রা টাকা ফেরত চাইছে, আমি দিতে পারছি না। লজ্জায় কারো সামনে দাঁড়াতেও কষ্ট হয়। ইউসুফ শুধু আমার স্বপ্ন ভেঙে দেননি, আমাকে সমাজে হেয় করেছেন, পরিবারকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রতিনিয়ত অশান্তি। সব মিলিয়ে জীবন এক দুঃসহ অভিশাপে পরিণত হয়েছে।’

জুনিয়র ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় স্থানীয় যুবক ওমর ফারুককে। চাকরির আশায় ইউসুফকে দেন ৬ লাখ টাকা। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন বুকে লালন করেছি। গ্রামে যখন শুনলাম জুনিয়র ক্রীড়া শিক্ষক পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন ইউসুফ হাসান, তখন সেই স্বপ্ন যেন হাতের নাগালে চলে এলো। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেনÑ সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, শুধু টাকা দিলেই নিয়োগপত্র হাতে পাব। বিশ্বাস করে পরিবারের সমস্ত সঞ্চয়, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করা টাকা মিলিয়ে ৬ লাখ টাকা তুলে দিয়েছি।’

ওমর ফারুক বলেন, ‘স্ট্যাম্পে লিখিতভাবে টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকারও করেছিলেন তিনি। ভেবেছিলাম, যদি কোনো কারণে চাকরি না-ও হয়, অন্তত টাকা ফেরত পাব। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ না চাকরি হলো, না টাকা ফেরত মিলল। আজও আমি সেই টাকার জন্য অপেক্ষা করছি। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, পরিবার নিয়ে রাস্তায় বসার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সন্তানদের স্কুলের খরচ, সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করা পর্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করিÑ কেন এমন এক প্রতারকের কথায় ভরসা করলাম! ইউসুফ শুধু আমার স্বপ্ন ভাঙেননি, পুরো পরিবারকে হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন। একসময় যে আশা নিয়ে বেঁচে ছিলাম, তা আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।’

আজিজুন নাহার কিংবা ওমর ফারুকই শুধু নন, ইউসুফের প্রতরণার ফাঁদে পড়েছেন দিলরুবা আক্তার, ‎প্রত্যয় দাশ, ‎আমিনুল ইসলাম, ইকবাল হোসেন, আলতাফ হোসেন, সৈয়দা আজিজা বেগম, স্মৃতি রানী দাশ, ডলি আক্তার, মো. আলাউদ্দিন, আফরোজা আক্তার, ফারুক হোসেন, হুমায়ুন কবির, ইসমাইল হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, আল আমিন, সোনিয়া আক্তার, সেলিনা আক্তার, মো. শামীম মিয়া, গাজী লোকমান হোসেন, কামরুন নাহারসহ আরও শতাধিক ব্যক্তি।
সালমা আক্তার, শাহনাজ আক্তার, সাহিনুর আক্তারÑ একইভাবে শিক্ষক পদে নিয়োগের নামে লাখ লাখ টাকা হারিয়েছেন। ইউসুফ তাদের আলাদা আলাদাভাবে চুপ করিয়ে রেখেছিলেন, যাতে প্রতারণা ফাঁস না হয়। অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, টাকা ফেরত চাইতে গেলে ইউসুফ উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেন। এমনকি থানায় অভিযোগ ও আদালতে মামলা হলেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে গেছেন। 

ইউসুফ কেবল টাকা হাতিয়েই ক্ষান্ত হননি, ভুক্তভোগীদের উল্টো বিপদে ফেলার কৌশলও নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, যাদের কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন এবং প্রতিশ্রুতির নিশ্চয়তা দিতে স্ট্যাম্প বা চেক দিয়েছেন, পরবর্তীতে সেই ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধেই তিনি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ভুক্তভোগীরাই নাকি জোর করে তার কাছ থেকে স্ট্যাম্প ও চেক নিয়েছেন। এমন ঘটনায় বহু ভুক্তভোগী মামলা হয়রানির শিকার হয়েছেন। অনেকেই দীর্ঘদিন আদালত ও থানা-পুলিশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। তবে কয়েকটি মামলায় তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। একপর্যায়ে আদালত উল্টো ইউসুফের বিরুদ্ধে জরিমানা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু তার পরও প্রতারণার এই চক্র বন্ধ হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার নামে জোর করে স্ট্যাম্প ও চেক নেওয়ার অভিযোগে ইউসুফ কোর্টে মামলা করে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সবকিছু খতিয়ে দেখে প্রমাণ পান, পুরো ঘটনাই মিথ্যা। তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেওয়ার পর ইউসুফ নিজেই আমার কাছে এসে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিল। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, শিগগিরই সব টাকা ফেরত দেবে। কিন্তু আজও সেই টাকা ফেরত পাইনি। উল্টো সে এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে।’

স্থানীয়রা বলছেন, ইউসুফের প্রতারণায় অনেকে পথে বসার উপক্রম হয়েছেন। কেউ আত্মীয়স্বজনের কাছে ধার করা টাকা ফেরত দিতে না পেরে সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন, কেউ আবার ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে মানসিক কষ্টে ভুগছেন। অথচ ইউসুফ গ্রামে এবং বাইরে নিজেকে সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে উপস্থাপন করেন।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ ইউসুফ হাসানের মন্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়। রূপালী বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তাকে ফোন করলে পরিচয় জানার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলটি কেটে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও ইউসুফ ফোন ধরেননি।

ইউসুফের প্রতারণার বিষয়ে নরসিংদী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাঈম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘ইউসুফ হাসানের কর্মকা- সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এরই ধারাবাহিতায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলাগুলো বিচারাধীন। এ ছাড়া ইউসুফের নেতৃত্বাধীন কমিটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে।’ একাধিক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে ইউসুফ। এ বিষয়ে মনোহরদী থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ দুলাল আকন্দ বলেন, ‘ইউসুফ হাসানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। আমরা তাকে ধরার জন্য তৎপর রয়েছি। আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি, সে এলাকায় নেই। তবে তাকে ধরার জন্য আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সে যেখানেই থাকুক, তাকে আইনের আওতায় আসতে হবে।’
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!