- ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ২৪৬ জন সাংবাদিক নিহত
- চলতি বছর বিশে^র বিভিন্ন দেশে হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জন সাংবাদিককে
- ২০২৪ সালে ১৮টি দেশের ১২৪ জন সাংবাদিক হত্যাকা-ের শিকার
- ২০২৪ সালে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে সবচেয়ে বেশি অবনতি আফগানিস্তান, বারকিনা ফাসো এবং মিয়ানমারে।
- বিশ্বে ৩৬১ সাংবাদিক কারাবন্দি
- গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ১৬ ধাপ উন্নতি বাংলাদেশের
মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তান, সম্প্রতি দেশটিতে সাবেক দুই সম্পাদককে পাঁচ বছরের কারাদ- দিয়েছেন আদালত। সাংবাদিক ঝুমার্ট দুলাতোভ ও আলেকজান্ডার আলেকজান্দ্রভকে ‘মিথ্যা তথ্য ছড়ানো তথা গুজব এবং জনশৃঙ্খলা নষ্ট করার’ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ২০২৫ সালের শুরুতে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে দুলাতোভ ও আলেকজান্দ্রভকে আটক করে। নিখুঁত সংবাদ সংগ্রহ কখনোই সহজ কাজ নয়। ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল সত্যকে বের করে আনতে হয় বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল দিয়ে। এ ধরনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় চলে না পক্ষপাতিত্ব। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব দেখিয়ে এ ধরনের কাজ করতে হয়। যে কারণে কখনো কখনো সংবাদই হয়ে ওঠে সংবাদকর্মীর জন্য মৃত্যুফাঁদ। বর্তমানে বিশে^র বিভিন্ন দেশে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর প্রায়শই নেমে আসে সরকারের কঠোর খড়গ। এ ছাড়া বিশে^র যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদগুলোয় প্রতিনিয়তই সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর পাই।
সম্প্রতি নেপালে জেন-জি নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলা করা হয়। সংবাদমাধ্যম কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে অপরাধীগোষ্ঠী সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়, সংবাদমাধ্যম কার্যালয়ে ভাঙচুর করে ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে কান্তিপুর ডেইলি, কান্তিপুর এফএম ও কান্তিপুর টিভির কার্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস হয়। অগ্নিকা-ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্নপূর্ণ ডেইলি ও এপি১ টিভির ভবন।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) সম্প্রতি জানায়, ২০২৪ সালে বিশ্বে রেকর্ডসংখ্যক সাংবাদিক হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। সিপিজের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, ২০২৪ সালে ১৮টি দেশের ১২৪ জন সাংবাদিক হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই গাজায়। ২০২৪ সালে গাজায় ৮৫ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুসারে, ৭ অক্টোবর, ২০২৩ সাল থেকে ইসরায়েল ২৪৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছে। সিপিজে ৩৬ বছর ধরে সাংবাদিক হত্যার তথ্য রাখছে। এ ছাড়া চলতি বছর বিশে^র বিভিন্ন দেশে হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জন সাংবাদিক।
সিপিজে জানায়, এ ছাড়া সংস্থাটির জেল শুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৩৬১ জন সাংবাদিক কারারুদ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আটক হয়েছেন চীনে। দেশটিতে ৫০ জনকে আটক করা হয়। এর পরই আছে ইসরায়েল। দেশটিতে আটক আছেন ৪৩ জন। ইসরায়েলের আটক করা সব সাংবাদিকই ফিলিস্তিনি। কারাবন্দি সাংবাদিকদের সংখ্যার ভিত্তিতে সিপিজের করা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। তিন কারাবন্দি সাংবাদিক নিয়ে প্রতিবেশী ভারত আছে ১৫তম স্থানে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে কারারুদ্ধ তিনজনের মধ্যে দুজন ২০২৩ সালে কাশ্মীর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত বছর বাংলাদেশ ও ভারতের তুলনায় আফগানিস্তানে কমসংখ্যক সাংবাদিক কারাবন্দি হয়েছেন। দেশটিতে দুজন সাংবাদিক কারারুদ্ধ হন। এ ছাড়া গত বছর গ্রেপ্তার সাংবাদিকদের মধ্যে একজনকে মৃত্যুদ- ও ১০ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫৪ জন সাংবাদিককে ১০ বছরের বেশি ও ৫৫ জনকে পাঁচ থেকে ১০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। সিপিজের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রতিবেদকরাই সবচেয়ে বেশি আটক হয়েছেন। ৩৫ সাংবাদিক আটক করে তালিকায় তৃতীয় স্থানে মিয়ানমার, ৩১ জনকে আটক করে চতুর্থ স্থানে বেলারুশ ও ৩০ সাংবাদিককে কারাগারে নিয়ে পঞ্চম স্থানে রয়েছে রাশিয়া।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও সাংবাদিকদের ওপর হামলা বা সাংবাদিক নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ১৯৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে হত্যার হুমকি পেয়েছেন ৮ জন। এই সময়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে মামলার আসামি হয়েছেন ৪৪ জন সাংবাদিক। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ছয় সাংবাদিক।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার সময় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১তম। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৫ বছরে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ৪৪ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এ বছর বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সূচকে এবারও বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিস্থিতি বেশ গুরুতর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৫ সালের সূচক থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ৩৩ দশমিক ৭১ স্কোর নিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম। ২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম। নেপাল (৯০তম), শ্রীলঙ্কা (১৩৯তম) ও মালদ্বীপ (১০৪তম) বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। গণমাধ্যম হলো একটা জাতির ভিত্তি। আর এ ভিত্তি মজবুত রাখতে প্রয়োজন এর নিরপেক্ষতা, সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকের মূল বৈশিষ্ট্য হলো নীতি ও নৈতিকতা।
স্টকহোমভিত্তিক থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের (আইডিইএ) বার্ষিক প্রকাশনা গ্লোবাল স্টেট অব ডেমোক্রেসি রিপোর্টের ২০২৫ সংস্করণে ১৭৪টি দেশের তথ্য নিয়ে প্রকাশিত এক সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নাটকীয়ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। ফলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দুরবস্থায় রয়েছে। সংস্থাটির দাবি, ১৯৭৫ সালে এ প্রতিবেদন প্রকাশ শুরুর পর থেকে বর্তমানেই সবচেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। এর কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ক্রমাবনতিকে দায়ী করছে আইইডিএ। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বিশ্বের ৯৪টি দেশে গণতন্ত্রের অবনতি ঘটেছে। অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দেশ।
এ বিষয়ে থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব কেভিন কাসাস-জামোরা বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এখন বড় এক ঝড়ের মুখে। ব্যাপক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পুনরুত্থান ঘটছে স্বৈরশাসনের। এর সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে গভীর অনিশ্চয়তাও। এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে নির্বাচন ও আইনের শাসনের মতো গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানগুলোর সুরক্ষা দিতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কাঠামোর মধ্যেও গভীর সংস্কার আনতে হবে, যাতে তা ন্যায়বিচার, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা ও সম্মিলিতভাবে সবার সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে।’
এদিকে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সূচকে এবারও বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিস্থিতি ‘বেশ গুরুতর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) তাদের ২০২৫ সালের সূচক প্রকাশ করেছে। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম, স্কোর ৩৩ দশমিক সাত এক। ২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম, এর আগের বছর ছিল ১৬৩তম। এ ছাড়া বিশ্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে গেল বছরের তুলনায় ছয় ধাপ পিছিয়েছে পাকিস্তান। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে এবার পাকিস্তানের অবস্থান ১৫৮তম।
যেসব দেশে স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে এবং পরে আবার ফিরে এসেছেÑ সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আর আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা যায়নি বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। হংকংয়ে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য হুমকি হয়ে এসেছে নতুন নিরাপত্তা আইন। মিয়ানমারে বিভিন্ন প্রকাশনার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। মালয়েশিয়ায় সরকারের সমালোচনা করায় সাংবাদিকদের হয়রানি ও কারাবন্দি করা হয়েছে। ফিলিপাইনের শ্রদ্ধেয় অনুসন্ধানী সাংবাদিক মারিয়া রেসাকে দুই বছরে ১০ বার বন্দি করা হয়েছে এবং বিতর্কিত আইনের অধীনে তার বিরুদ্ধে ‘সাইবার মানহানির’ অভিযোগ আনা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতে, মোদি সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করেছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন