আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস না পাওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। পাশপাশি অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
ডব্লিউএমও’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত ৫০ বছরে প্রাণ হারিয়েছে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। যার মধ্যে ৯০ শতাংশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তবে গেল দশকে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। বর্তমানে অন্তত ১০৮টি দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানানোর ব্যবস্থা থাকলেও আগে এ সংখ্যা ছিলো মাত্র ৫৮। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে করা একটি জরিপ অনুযায়ী, ৬২টি দেশের মধ্যে অর্ধেকেরই কেবল মৌলিক সতর্কবার্তা জানানোর সক্ষমতা রয়েছে। আর ১৬ শতাংশেরও কম দেশের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানানোর ক্ষমতা প্রাথমিক সক্ষমতার নিচে।
ডব্লিউএমও বলছে, ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী সঠিক সময়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস না পাওয়া। সতর্কবার্তার অভাবে পর্যাপ্ত পূর্বপ্রস্তুতি নিতে না পারায় প্রতিবছর প্রাণ হারাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। এমনকি পূর্বাভাস পাওয়ার ব্যবস্থা নেই এমন দেশগুলোতে প্রাণহানি স্বাভাবিকের তুলনায় ছয়গুণ বেশি।
ডব্লিউএমওয়ের মহাসচিব সেলেস্তো সাউলো বলেন, ‘পূর্ব সতর্কীকরণ মানে, পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আমাদের লক্ষ্য কেবল বিশ্বকে সর্তক করা নয় বরং বৈশ্বিক ক্ষমতায়ন সৃষ্টি করা। আগামী বছরগুলোতে টেকসই ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার সুযোগ রয়েছে। আমরা শুধু পর্যবেক্ষক নই, আমরা টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর।’
চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগেরই তীব্রতা আগের দুর্যোগের তুলনায় অনেক বেশি। মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে তীব্র বন্যা, ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল-এসব বিপর্যয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়ে পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপসহ অনেক দেশ।
প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ বাড়ানোর পাশাপাশি পূর্বাভাস ব্যবস্থার পরিসর বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে ডব্লিউএমও। বনাঞ্চল উজাড়, কলকারখানা, অতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবহারসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণেই বৈশ্বিক জলবায়ুতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। যার বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতে। সারাবছরই খরা, বন্যা, ভূমিধস, ভূমিকম্প ও দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে। আর দিন দিন ভয়াবহ হয়ে ওঠছে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
চলমান এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই আরো একটি দু:সবাদ দিয়েছে ডব্লিউএমও। দু:সংবাদে বলা হয়েছে, শিল্প বিপ্লবের আগের তুলনায় ২০২৪ সালে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা রেকর্ড ৫২ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ, অতীতের রেকর্ড ভেঙে বায়ুম-লে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা এমন পর্যায় পৌঁছেছে; যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে আর কখনোই দেখা যায়নি।
ডব্লিউএমও জ্যেষ্ঠ গবেষক ওকসানা তারাসোভা বলেন, ‘যখন পৃথিবীতে মানুষ ছিলো না, তখন বায়ুম-লে একই রকম কার্বন ডাই অক্সাইড ছিলো। এটি প্রায় ৩০ থেকে ৫০ লাখ বছর আগের কথা। এটি শেষবার যখন বায়ুম-লে ছিলো তখন প্রতি মিলিয়নে ৪০০ ভাগেরও বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড দেখা গেছে। তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিলো। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩২ থেকে ৬৬ ফুট বেশি ছিলো।’
জানা গেছে, ১৯৬০ এর দশকের পর কার্বন ডাই অক্সাইডের এ বৃদ্ধির হার তিনগুণ বেড়েছে। এছাড়াও নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনত্ব বেড়েছে রেকর্ড ২৫ শতাংশ। এমনকি গ্রিনহাউস গ্যাস ও মিথেনের মাত্রাও রেকর্ড ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মাত্রা সার্বিকভাবে ৮ লাখ বছর আগের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন ডব্লিউএমও’র জ্যেষ্ঠ গবেষক ওকসানা তারাসোভা। যা জলবায়ুকে টার্বো-চার্জ করছে বা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো দ্রুত গতিতে তীব্র হচ্ছে। ফলে পৃথিবী আরও উষ্ণ হচ্ছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো দিন দিন অনেক বেশি তীব্র হচ্ছে।
ওকসানা তারাসোভা আরও বলেন, ‘যদি আমরা এটিকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে ৮ লাখ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। পর্যবেক্ষণ ইতিহাসে দেখা গেছে, তখনকার কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের বর্তমান সর্বোচ্চ মাত্রার সঙ্গে মিল ছিলো।’
নভেম্বরে ব্রাজিলে হতে যাওয়া জলবায়ু শীর্ষক ৩০তম কপ সম্মেলন শুরুর প্রায় এক মাস আগে এ তথ্য সামনে আনলো বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগের পাল্লা ভারী করেছে আরও একটি তথ্য। তা হলো, ১০ বছর ধরে পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন বন যতটা কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে তার চেয়ে বেশি নির্গমন করছে।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণতা বেড়েছে ইউরোপের দেশ আইসল্যান্ডে। চলতি বছরেই ২৯.৫ ডিগ্রির রেকর্ড ছুঁয়েছে দেশটির তাপমাত্রা। যা দেশটির ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৩৯ সালে আইসল্যান্ডের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো ৩০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রেকর্ড তাপমাত্রায় দেশটিতে প্রথমবারের মতো মশার সন্ধানও পাওয়া গেছে। ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে দেশটি মশামুক্ত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিলো।
এত দু:সংবাদের মধ্যেও সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স জানিয়েছে, সঠিক সময়ে পূর্বাভাস পাওয়ায় চলতি বছরের মে মাসে হিমবাহ ধসের হাতে থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্লাটেন গ্রামকে সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।

