জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলছে চাকরি ছাঁটাই আতঙ্ক। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সম্মুখ সারির সব নেতাকে এরই মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পরে ছাঁটাই ও বদলির মাধ্যমে পুনর্গঠিত হলেও ভেতরে ক্ষোভ রয়েই গেছে। এই ক্ষোভের মধ্যেই গত সপ্তাহে রাজস্ব খাত সংস্কারের অধ্যাদেশে বড় সংশোধনও আনা হয়েছে। তবে অস্থিরতা কাটছে না, মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সদ্য বরখাস্তকৃতরা।
চলতি বছরের ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাÑ এ দুটি বিভাগ করার অধ্যাদেশ জারি হয়। সেই নতুন অধ্যাদেশে মোট ১১টি সংশোধন আনার প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাসও হয়েছে। অধ্যাদেশে অন্যতম প্রধান সংশোধন হলোÑ রাজস্বনীতি বিভাগে রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে প্রধান করা হবে। এখানে বিষেভাবে গুরুত্ব পাবে ‘যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও ন্যায্যতা’।
তার আগে এনবিআর ঐক্য পরিষদের আন্দোলনের জেরে ১৩৬ জন সহকারী কর কমিশনারকে বদলি করা হয়েছে। অন্যদিকে, আন্দোলনের জেরে এনবিআর সদস্য থেকে প্রহরী পদবি পর্যন্ত গত দেড় মাসে ৩৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আইআরডি সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান চার কর্মকর্তার বরখাস্তের পৃথক চারটি আদেশে সই করেন। তবে ‘সাময়িক বরখাস্তকালীন তারা বিধি মোতাবেক খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন।’
আন্দোলনকারীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘তারা বৈধভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। এনবিআরের দুটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় ঘাটতি ছিল বলে তারা স্বীকার করেন। তবে অপ্রত্যাশিত যদি কিছু ঘটে থাকে, তা আমাদের ওপর করা হচ্ছে। বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে তা করছে এনবিআর।’ সাময়িক বরখাস্ত হওয়া চাকরিজীবীরা আরও বলেন, ‘আমরা আদালতে যাব, তারই প্রস্তুতি চলছে।’ এর বাইরে তারা গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি।
চলতি বছরের মেÑজুন মাসে রাজস্ব খাতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ২৮ ও ২৯ জুন সারা দেশে কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামেন তারা। এরপর ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় আন্দোলন প্রত্যাহার করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে এনবিবআর।
১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাÑ এ দুটি বিভাগ করার অধ্যাদেশ জারি হয়। এর পর থেকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে প্রায় দেড় মাস আন্দোলন করেন। তবে আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এনবিআরের তিন সদস্য ও এক কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
কাজ বন্ধ রাখার দায়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তৎকালীন কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া এনবিআরের দুই সদস্যসহ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তাদের অধিকাংশই এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
এনবিআরের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সরকার কর্তৃক গত ১২ মে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির পর এর বিরোধিতা করে এনবিআর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট এবং আয়কর বিভাগের কর্মচারীরা। দায়িত্বরত কর্মচারীদের দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনে বাধা প্রদান করা হয়েছে। এর পাশাপাশি কাজ ত্যাগ করে রাজস্ব ভবনে আসতে বাধ্য করতে সংগঠকের ভূমিকা পালনের মাধ্যমে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।’
বরখাস্তের তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য ব্যারিস্টার মোতাসিম বিল্লাহ ফারুকি বলেন, ‘নেগেটিভ আন্দোলনে যারা সম্মুখভাগে ছিলেন, তাদেরই বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এনবিআর। নতুন করে লিস্ট আরও দীর্ঘায়িত হবে বলে আমি মনে করি না।’ তবে ‘সাময়িক বরখাস্থ মানে শাস্তি নয়’। ‘আন্দোলনের শুরুতে আমিই প্রথম গণমাধ্যমে কথা বলেছি।’ বলেন ফারুকি।
এনবিআর ঐক্য পরিষদের আন্দোলনের জেরে এ পর্যন্ত ১৩৬ জনকে বদলি করা হয়েছে। আন্দোলন-পরবর্তী বদলি স্থানে পুনঃস্থাপন করছে এনবিআর। আতঙ্কিত সময়ে বদলি সম্পর্কে জানতে চাইলে এনবিআর বোর্ড ও কর প্রশাসন এবং সদস্য জিএম আবুল কালাম কায়কোবাদ বলেন, ‘বদলি নিয়মিত কাজের একটি অংশ। তবে সংবেদনশীল সময়ে হওয়ায় এটা প্রশ্নবিদ্ধ। এক দিনে বহুসংখ্যক কর্মী বদলিবিন্যাসে কাজ করে এনবিআর।’
এদিকে, রাজস্ব খাতের সংস্কারের অধ্যাদেশে বড় সংশোধন আনা হয়েছে। বহুল আলোচিত অধ্যাদেশে মোট ১১টি সংশোধন আনার প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাসও হয়েছে। ‘যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও ন্যায্যতার’ ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে এবং ন্যস্ত করা জনবল থেকে প্রয়োজনীয় জনবল বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে রাজস্বনীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে। এমন আরও ১০টি বিধান রেখেই সংশোধনীর প্রস্তাব পাস হয়েছে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সম্প্রতি বলেন, ‘আমরা অধ্যাদেশটি সংশোধনের বিষয়ে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছি। এগুলো হলোÑ যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও ন্যায্যতা। এর মানে হলো, যাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তিনি যোগ্য কি না, তা দেখা হবে; তিনি কাজটি সম্পর্কে অভিজ্ঞ কি না এবং যাকে কাজটি দেওয়া হচ্ছে, তিনি ন্যায্য লোক কি নাÑ এসব বিষয় বিবেচনা করে সংশোধন করা হয়েছে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন