ঢাকা মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর, ২০২৫

ভুল করে সঠিক জিনিস আবিষ্কার

মিনহাজুর রহমান নয়ন
প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৫, ০৩:৩১ এএম

সাধারণত কোনো চিন্তা থেকে একটা আবিষ্কারের নেশায় ডুবে থাকে বিজ্ঞানিরা। কিন্তু, সবকিছুই কি সঠিক নিয়মে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই গোলমেলে হয়ে যায় সব। বাঁধে বিপত্তি। মজার বিষয় হলো এই ভুল থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে মন্দ কী? আর সেই ‘দারুণ কিছু’ যদি হয় পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়া সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, তবে তো কথাই নেই! বিজ্ঞানের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসই ভুল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। তেমনই কিছু আবিষ্কার আর তার পেছনের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন

সুপার গ্লু

কোনো জিনিস ভেঙে গেলে প্রথমেই আমাদের মাথায় যে জিনিসটির কথা আসে সেটি হচ্ছে সুপার গ্লু। এই সুপার গ্লুর উদ্ভাবনও হয়েছিল নিতান্তই কাকতালীয়ভাবে! ১৯৪২ সালের কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। ড. হ্যারি কুভার গবেষণা করছিলেন মিত্র বাহিনীর পক্ষ নিয়ে। তিনি এমন একটি গান সাইট বানাতে চাইছিলেন যা মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা ব্যবহার করতে পারবে। কাজ করতে গিয়ে তিনি এক ধরনের আঠা তৈরি করে ফেললেন যেটি খুব দ্রুত ভীষণ শক্তিশালী বন্ধন গড়তে সক্ষম! কিন্তু গান সাইট তৈরি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ড. কুভার তখন সেই আঠাটি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালেন না। তারপর কেটে গেল অনেক বছর। ১৯৫১ সালে ড. কুভার কর্মরত ছিলেন ইস্টম্যান কোডাক কোম্পানিতে। সেখানে প্লেনের ককপিটের ওপরের আবরণের জন্য তাপ প্রতিরোধী দ্রব্য তৈরি নিয়ে কাজ করছিলেন। সেখানেই সেই নয় বছর আগেকার আঠা আবার উদ্ভাবন করেন তারা। যখন আঠাটি একজোড়া রিফ্রাক্টোমিটার প্রিজমের মাঝে লাগালেন, তখন সবাই অবাক হয়ে দেখল সেগুলো অত্যন্ত শক্তভাবে একে অপরের সঙ্গে লেগে গিয়েছে! এবার আর নিজের আবিষ্কৃত আঠা ‘অ্যাডহেসিভ সায়ানোঅ্যাক্রিলেট’ কে অবজ্ঞা করতে পারলেন না কুপার। বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো আজকের বহুল ব্যবহৃত সুপার গ্লু।

পটেটো চিপস

পটেটো চিপস প্রথম তৈরি করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের এক শেফ। জর্জ ক্রাম নামের সেই শেফ কাজ করতেন মুনস লেক হাউস নামের এক রেস্তোরাঁয়। সেখানে গ্রাহকদের কাছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার ছিল। ১৮৫৩ সালের কথা, একদিন এক ক্রেতা এসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের অর্ডার দিলেন। যথারীতি জর্জ ক্রাম খাবার প্রস্তুত করে পাঠালেন, কিন্তু সেই ক্রেতা গ্রাহক ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের আলুগুলো  খুব মোটা বলে অভিযোগ করেন এবং সেগুলো আরও পাতলা করে আনার জন্য ক্রামকে বার বার রান্নাঘরে পাঠাচ্ছিলেন। বিরক্ত ক্রাম আলুর টুকরাগুলোকে একদম পাতলা করতে করতে কাগজের মতো পাতলা করে ফেললেন! তারপর সেগুলোকে মচমচে করে ভেজে বেশি করে লবণ মাখিয়ে সেই ক্রেতার সামনে পরিবেশন করেন। এবার কিন্তু ক্রামকে অবাক করে দিয়ে গ্রাহক সেগুলো খুব পছন্দ করে খেলেন। ব্যস! আবিষ্কার হয়ে গেল আমাদের প্রিয় পটেটো চিপস!

কোকা-কোলা

পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়র কথা উঠলে  চলে আসবে বিশ্বখ্যাত কোকা-কোলার কথা। কিন্তু এই কোকা-কোলার আবিষ্কার কীভাবে হলো সেটি কি জান? জন স্মিথ পেমবার্টন হলেন কোকা-কোলার আবিষ্কারক, পেশায় তিনি ছিলেন একজন হাতুড়ে ডাক্তার বা রসায়নবিদ। তিনি তার তৈরি করা ওষুধ ফেরি করে বিক্রি করতেন, আর অবসরে আবিষ্কারের নেশায় মেতে থাকতেন। ১৮৮৬ সালে তিনি এক ধরনের সিরাপ আবিষ্কার করেন। একদিন দোকানে এক লোক এলো প্রচ- মাথাব্যথা নিয়ে, এসেই এক গ্লাস সিরাপ চাইল। কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে সিরাপ ঠান্ডা পানির পরিবর্তে কার্বোনেটেড মেশানো পানির সঙ্গে মিশ্রিত ছিল। মজার ব্যাপার লোকটি সেই বিচিত্র সিরাপ খেয়ে দারুণ আনন্দ পেল! তখনই পেমবার্টনের মাথায় আইডিয়া এলো এই পানীয়টি বাজারজাত করার। প্রথম বছরে তিনি ৫০ ডলার আয় করেন কিন্তু ব্যয় হয় ৭০ ডলার। গচ্চা খেয়ে বিমর্ষ পেমবার্টন তার প্যাটেন্টটি বিক্রি করে দেন। মূলত কোকা-কোলা জনপ্রিয় হয় সেই ক্রেতার মাধ্যমেই। তারপরের গল্প সবারই জানা।

পেসমেকার

মানুষের স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন মিনিটে ৬০-৯০টি। হৃৎস্পন্দন যখন কমে যায় তখন এটাকে স্বাভাবিক করার জন্য পেসমেকার ব্যবহৃত হয়। লাখো মানুষের প্রাণ রক্ষাকারী এই পেসমেকারের উদ্ভাবন হয়েছে একদম ভুলবশত! উইলসন গ্রেটব্যাচ নামের এক বিজ্ঞানী ছিলেন, তিনি এমন একটি উপায় খুঁজছিলেন যেন হৃৎপি-ের ব্লক সারিয়ে সেটিকে কর্মক্ষম করে তোলা যায়। পশুদের হৃৎস্পন্দনের শব্দ রেকর্ড করার জন্য তিনি একটি অসিলেটর আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে মনের ভুলে উইলসন একটি ট্রানজিস্টর সেই যন্ত্রে স্থাপন করেন। তারপর যখন সুইচ অন করেন তখন চেনা একটা শব্দের সঙ্গে মিল খুঁজে পান! শব্দটি এমন একটি ধরন মেনে চলছে যা মানুষের হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়!

উইলসনের এই আবিষ্কারের পরবর্তীতে নাম দেওয়া হলো পেসমেকার। ১৯৬০ সালে পেসমেকার প্রথম মানুষের দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়।

স্যাকারিন

বিজ্ঞানীর অজান্তেই আবিষ্কার হয়ে গেল স্যাকারিন। কিন্তু কীভাবে?

১৮৭৯ সালের কথা। অবসরটুকু কাজে লাগাবেন ভেবে গবেষণাগার থেকে বিজ্ঞানী কনস্টাইন ফাহলবার্গ হাতে করে কিছু সামগ্রী বাসায় নিয়ে এলেন। এদিকে খাওয়ার সময় হলে কিছু খাবার নিয়ে চটপট খেতে বসে গেলেন ফাহলবার্গ। কিন্তু খাবার মুখে দিয়েই থমকে গেলেন তিনি। খাবারের ভেতর চিনি জাতীয় কিছুই নেই, তাহলে তার হাতের রুটিটাকে মিষ্টি লাগছে কেন? বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী ফাহলবার্গ বুঝতে পারলেন এই মিষ্টতার উৎস তার হাতের আঙ্গুল! গবেষণাগারে যে রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে কাজ করছেন সেগুলো থেকে আঙ্গুলে মিষ্টতা এসেছে। মজা পেয়ে তিনি এই চিনি জাতীয় পদার্থের ওপর আরও বেশি গবেষণা চালাতে লাগলেন। আবিষ্কার হলো চিনির প্রধান বিকল্প স্যাকারিন।