মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৫, ০১:০৯ এএম

প্রাথমিক শিক্ষায় অগ্রগতি হলেও মান নিয়ে প্রশ্ন মালিহা মেহনাজ, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৫, ০১:০৯ এএম

প্রাথমিক শিক্ষায় অগ্রগতি হলেও মান নিয়ে প্রশ্ন মালিহা মেহনাজ, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

‘শিক্ষাই জাতির মেরুদ-’ এই চিরন্তন সত্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত দুই দশকে দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশাধিকার ও অংশগ্রহণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি পদক্ষেপ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সামাজিক সচেতনতার ফলে বিদ্যালয়ে ভর্তি হার প্রায় শতভাগে পৌঁছেছে। তবে, আশার আলো জ্বললেও এর পেছনে অন্ধকার দিকও রয়েছে, আর তা হলো প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার প্রায় ৯৮%। প্রতি বছর প্রায় ৩ কোটির বেশি শিশু সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই শিশুরা বিদ্যালয়ে গিয়ে কী শিখছে? গ্রামাঞ্চলের অনেক শিশু চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণিতেও পাঠ্যবই পড়ে বুঝতে পারে না, এমনকি নিজে থেকে সঠিকভাবে একটি বাক্য লেখার ক্ষমতাও অর্জন করে না। একই সঙ্গে শহরের কিছু বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলিক গাণিতিক দক্ষতার অভাব লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিগত দুই দশকে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ে শিশুর ভর্তি হার আজ প্রায় শতভাগে পৌঁছেছে। ইউনিসেফ ও প্রাথমিক এবং গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ শিশু পড়াশোনা করছে, যা এই খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচিত। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, উপবৃত্তি প্রদান, মিড-ডে মিল, স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম, নারী শিক্ষকের নিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এই অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে পাহাড় ও চরাঞ্চলেও শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। এমনকি প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রেও বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়ার হারও আগের তুলনায় কম। 
কিন্তু এ অগ্রগতির পেছনে রয়েছে এক গোপন সংকট, যা ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, তা হলো শিক্ষার মান। অনেক ক্ষেত্রে শুধু পরিসংখ্যানগত উন্নয়নই বাস্তবতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভর্তি হয়েছে সত্য, কিন্তু শিশু কতটা শিখছে? বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকলেও তারা কি পাঠ্যবস্তু বুঝতে পারছে, প্রয়োগ করতে পারছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই জাতিগতভাবে আমরা একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণি শেষ করার পরও বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য গঠন করতে পারে না। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে এসেও অনেক শিক্ষার্থী মৌলিক গাণিতিক প্রশ্নের সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়। তারা পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও প্রকৃত অর্থে বিশ্লেষণ ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে দুর্বল থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য পূরণে এক বড় প্রতিবন্ধকতা।
বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানেই নেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, নেই খেলার মাঠ, নেই শৌচাগার বা বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। অনেক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে একই সঙ্গে একাধিক শ্রেণির দায়িত্ব পালন করতে হয়। যে বয়সে শিশুদের শেখা উচিত আনন্দের মাধ্যমে, সেই বয়সেই তারা মুখস্থনির্ভর পাঠ্যপদ্ধতির চাপে পড়ে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে।
গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। রাজধানী বা বড় শহরের কিছু স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি থাকলেও, প্রত্যন্ত এলাকার অনেক বিদ্যালয়ে এখনো ব্ল্যাক বোর্ড ও খাতা-কলমই একমাত্র নির্ভরতা। শিক্ষার্থীদের শেখার পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত এবং পাঠ্যবস্তুর মান, সব মিলিয়ে শহর ও গ্রামের শিক্ষার মধ্যে এক বড় পার্থক্য রয়ে গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, এনসিটিবি কর্তৃক পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (চঊউচ), ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, এবং পাঠদান পদ্ধতিতে প্রযুক্তির সংযোজন। বিশেষ করে ‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৪’ (চঊউচ-৪) এর মাধ্যমে সমতা, গুণগত মান এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিশুদের প্রাথমিক স্তরে মানসিক বিকাশ ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য শিশুবান্ধব শ্রেণিকক্ষ এবং সহপাঠ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।
তবে এসব ইতিবাচক উদ্যোগ সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো: এখনো দেশের বহু প্রান্তে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা সবার কাছে পৌঁছেনি। অনেক বিদ্যালয়ে পাঠ্যবই সময়মতো সরবরাহ হয় না, কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষা উপকরণ ও সহায়ক সামগ্রীর ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক ও ভাষাগত পার্থক্য বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যবই রচনা না করায় অনেক শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়া বিঘিœত হয়। আবার মূল্যায়ন ব্যবস্থাও এখনো মুখস্থনির্ভর এবং ‘সৃজনশীলতা’ নামক পদ্ধতিটি প্রয়োগের চেয়ে মুখস্থই বেশি গুরুত্ব দেয়।

শুধু সরকার নয়, অভিভাবক ও স্থানীয় সমাজকেও শিক্ষার মান উন্নয়নে আরও সক্রিয় হতে হবে। অনেক অভিভাবক এখনো মনে করেন প্রাথমিক শিক্ষা কেবল পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার মাধ্যম। কিন্তু শিশুর চিন্তাশক্তি, সামাজিকতা, মানবিকতা ও নৈতিক চেতনা গড়ে তোলার ভিত্তি এই পর্যায়ে তৈরি হয়। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও পারিবারিক সহযোগিতা নিশ্চিত না হলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
শিক্ষাবিদের মতে, শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ‘শিখন ফলভিত্তিক মূল্যায়ন’, ‘সমন্বিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ’, এবং ‘নিয়মিত তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণ’ জরুরি। শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত বেতন ও পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারলে তারা পড়ানোকে শুধু চাকরি নয়, একটি দায়িত্ব হিসেবে নেবেন। একইসঙ্গে শিক্ষা বাজেটে আরও বেশি বরাদ্দ দিয়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার, যাতে স্থানীয় প্রেক্ষাপট ভিত্তি করে পদক্ষেপ নেওয়া যায়। যদি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগত উন্নয়ন না আসে, তাহলে মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সম্ভব নয়। একটি শিশুর চিন্তা, বিশ্লেষণ, সহানুভূতি ও সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা তৈরি হয় প্রাথমিক পর্যায়ে। সেই ভিত্তি দুর্বল হলে পরবর্তী ধাপগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করলেও শিক্ষার গুণগত মান এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। শিশুদের কেবল বিদ্যালয়ে পাঠানোই যথেষ্ট নয়। তাদের শেখার পরিবেশ, মানসম্পন্ন শিক্ষক, উপযোগী পাঠ্যক্রম ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের প্রতিটি স্তরের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে পারে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি শিশু সত্যিকার অর্থেই নিজের, সমাজের ও জাতির ভবিষ্যৎ গঠনের কাজ সঠিকভাবে শিখতে পারবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!