নারী নেত্রী হেনা দাশ। পারিবারিক নাম হেনা দত্ত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী, নানকার আন্দোলনের নেত্রী, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভানেত্রী, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, ড. খুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য, শামসুল হক শিক্ষা কমিশনের সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাবেক সভানেত্রী, আন্তর্জাতিক শিক্ষক সমিতির সদস্য।
১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার স্বজনগ্রামের টাউনশিপে। লাখাই ঐতিহাসিক দত্ত বংশের মেয়ে। তার পিতা রায় বাহাদুর অ্যাডভোকেট সতীশ চন্দ্র দত্ত এবং মাতা মনোরমা দত্ত। মনোরমা দত্ত (জমিদার নন্দিনী) ছিলেন চুনারুঘাট থানার নরপতি গ্রামের জমিদার জগৎ চন্দ্র বিশ্বাসের মেয়ে।
১৯৩০ সালে হেনা দত্তের পিতা রায় বাহাদুর অ্যাডভোকেট সতীশ চন্দ্র দত্ত হবিগঞ্জ সদর-লাখাই-বানিয়াচং- আজমিরীগঞ্জ আসন থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। রায় বাহাদুর অ্যাডভোকেট সতীশ চন্দ্র দত্ত কিছুদিন ভারতবর্ষের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৩৬ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় হেনা দাশ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। সিলেটে প-িত জওহরলাল নেহরুকে (পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী) প্রথম দেখা এবং তার বক্তৃতা শোনা ছিল হেনা দাশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এরপর অষ্ট্রম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে সিলেটে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ছোটবেলা হতেই হেনা দাশ বিপ্লবী ছিলেন। তিনি এতোই বিপ্লবী ছিলেন যে চলন্ত ট্রেনে উঠতে পারতেন এবং নামতে পারতেন। ১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪০ সালে সিলেট অগ্রগামী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪২ সালে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯৪৩ সালে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে ম্যালেরিয়ার শত শত লোকের মৃত্যু ঘটে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কমরেড আদম আলী, হেনা দাশ, কমরেড তুলসী ভট্টাচার্য, ডা. গোপেশ বিশ্বাস, কমরেড রুহিনী দাশ, সত্যব্রত দত্ত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে গান গেয়ে চাঁদা তোলেন। সেই টাকা ম্যালেরিয়া রোগীদের মাঝে বিতরণ করতেন।
১৯৪৬ সালের সংগ্রামের জোয়ারের মধ্যেই নেত্রকোনা জেলায় ‘নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। নেত্রাকোনার সম্মেলনে লক্ষাধিক সংগ্রামী জনতার সামনে ‘গণনাট্য সংঘ’-এর শিল্পী হিসেবে প্রথম ও শেষবারের মতো সংগীত পরিবেশন করেন হেনা দাস।
১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুনীর চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হেনা দাশ নির্বাচিত হন।
একই বছর ২৮ জুন সুনামগঞ্জের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড রুহিনী দাশকে বিবাহ করেন। রুহিনী দাশকে বিবাহ করার পর হেনা রানী দত্ত থেকে হেনা দাশ হয়ে গেলেন। কমরেড রুহিনী দাশের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর থানার পরান বারুংকা গ্রামে। কমরেড রুহিনী দাশের আপন মামাতো ভাই হলেন আসাম পার্লামেন্টের মেম্বার করুনাসিন্ধু রায় (কমরেড বরুন রায়ের পিতা)।
১৯৫২ সালে সিলেটের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ভাষার দাবিতে ছাত্রদের মিছিল-মিটিং ও লিফলেট বিলিতেও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে এই আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করে তুলেন। গোপন আস্তানা থেকে মেয়েদের ভাষা-আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যান।
১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক ড. আখলাকুর রহমান এবং কিছু মুসলিম যুবককে নিয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সম্মেলন যশোরে অনুষ্ঠিত হয়। হেনা দাশ যশোর সম্মেলন শেষ করে ঢাকায় ফিরেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন। শিক্ষক নেত্রী হেনা দাশ বর্জন করেন শিক্ষাদান কার্যক্রম। বন্ধ করে দেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ঢাকা শহরে বিশাল মিছিল বের করা হয়। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গিয়ে মিছিল শেষ হয়। শিক্ষকরা ‘পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতি’ ব্যানার ছুড়ে ফেলে দেন। নতুন ব্যানার লিখেন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’। শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব হেনা দাশকে দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালে মে মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৪০০ জনের একটি দল নিয়ে মুন্সীগঞ্জ থেকে লঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় যান। তারপর ২৫-৩০ মাইল হেঁটে প্রথমে ভারতের আগরতলা যান। তারপর কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় পার্ক সার্কাস লেনে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্র স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থী শিবিরের বিদ্যালয় প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় শিক্ষক সমিতি বিদেশি সহায়তা পান। তিনি এই সাহায্য দিয়ে শরণার্থী শিবিরে ৫০টি বিদ্যালয় খুলেন। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শিক্ষকদের এসব বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেন। শিক্ষকদের প্রতি মাসে ১৫০-২০০ টাকা করে সম্মানী ভাতা দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী ও শিশুদের পোশাক এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য-দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে বিতরণ করতেন। শিশুদের পড়াশোনার জন্য অনেক ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা আবুল ফজল প্রধান অতিথি হয়ে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেই সম্মেলনে বাণী পাঠিয়েছিলেন।
পরের বছর প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে হেনা দাশকে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট পাকিস্তানপন্থি মাওলানা মান্নানের গু-াবাহিনী ও পুলিশ দিয়ে হেনা দাশ এবং অন্যান্য শিক্ষক নেতাদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। হেনা দাশকে কোর্টে চালান দেওয়া হয়। পরে কোর্ট থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারগারে পাঠানো হয়। এই মামলা আদালতে খারিজ হয়ে যায়।
হেনা দাশ দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে০র জন্য আজীবন কাজ করেছেন। সমাজটাকে পালটিয়ে দেওয়ার মহৎ উদ্দেশ্য থেকেই বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন সারাটা জীবন। স্বীকৃতি পেয়েছেন, পেয়েছেন সম্মাননা।
জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯২ সালে শাপলার বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা প্রদান, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখা সংবর্ধনা প্রদান, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, রোকেয়া হল শাখা নবীন বরন, ২০০১ সালে ড. আহমেদ শরীফ পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বেগম রোকেয়া পদক-২০০১, সুনামগঞ্জ পৌরসভা পুরস্কার-২০০৩, বিজনেস প্রফেশনাল ওমেন্স পদক ২০০৩, সুনামগঞ্জ জেলা কমিউনিস্ট পার্টি পুরস্কার-২০০৩, উইমেন্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংস্কৃতিক জোটের সংবর্ধনা, পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি হীরক জয়ন্তী পদক-২০০৪, সিলেটে প্রথম দিনের সূর্য পুরস্কার, অধ্যাপক আমেশ্বরী পুরস্কার, জাহানারা স্মৃতি পদক-২০০৫, মহানগর পরিবার দিবস পুরস্কার-২০০৬।
অনেক বই লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই হলো স্মৃতিময়-৭১, স্মৃতিময় দিনগুলো, পঞ্চম পুরুষ, লাখাই গ্রামের ইতিহাস নিয়ে আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘চার পুরুষের কাহিনি, ‘আমার শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন, নারী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা, নির্বাচিত প্রবন্ধ। বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন, সেমিনারে গিয়েছেন।
হেনা দাশ একই সঙ্গে কলম চালিয়েছেন। লিখেছেন জাতীয় পত্রিকায়, আন্তর্জাতিক পত্রিকায়। কে নো উচ্চাকাক্সক্ষায় ছিলেন না, শিক্ষক পেশায় সারা জীবন কাটিয়ে গেছেন।
২০০৯ সালের ২০ জুলাই সবাইকে কাদিয়ে মহীয়সী নারী পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। নারী নেত্রী হেনা দাশ দুই মেয়ে রেখে গেছেন। হেনা দাশের মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছেন একজন ভাষা সৈনিককে, হারিয়েছেন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে, হারিয়েছেন একজন আদর্শবান শিক্ষক নেত্রীকে। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সর্বস্তরের জনগণ তাকে শ্রদ্ধা জানানোর পর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা হয়।
আপনার মতামত লিখুন :